২৫৮. মৃত্যুর ভূতসংহারে অসম্মতিজ্ঞাপন

২৫৮তম অধ্যায়

মৃত্যুর ভূতসংহারে অসম্মতিজ্ঞাপন

‘‘অনন্তর আয়তলোচনা মৃত্যু কথঞ্চিৎ স্বীয় দুঃখ সংবরণপূর্ব্বক প্রজাগণের হিতার্থে কৃতাঞ্জলিপুটে বিনীতভাবে ব্রহ্মাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘ভগবন্! মাদৃশ অবলা [সরলা স্ত্রী] আপনা হইতেই সম্ভূত হইয়া কিরূপে সমুদয় জীবের ভয়েৎপাদনপূর্ব্বক ক্রূরকাৰ্য্যসম্পাদনে প্রবৃত্ত হইবে? আমি অধৰ্ম্মে একান্ত ভীত; অতএব আপনি অনুকূল হইয়া আমাকে ধৰ্ম্মকার্য্যে অনুজ্ঞা প্রদান করুন। বালক, বৃদ্ধ ও যুবাগণ আমার কি অপরাধ করিয়াছে যে, আমি তাহাদিগকে বিনাশ করিব? লোকের প্রিয়পুত্র, প্রিয়বয়স্য এবং পিতা, মাতা ও ভ্রাতৃবিনাশ করিতে আমি কখনই সমর্থ হইব না। লোকে আমার হস্তে নিপতিত হওয়াতে যারপরনাই কাতর হইয়া আমাকে নিশ্চয়ই শাপ প্রদান করিবে এবং তাহাদিগের শোকাপাতে আমাকে অনন্তকাল দগ্ধ হইতে হইবে। এই নিমিত্ত আমি একান্ত ভীত হইয়া আপনার শরণাগত হইয়াছি। আমি বিনাশ করিলে পাপাত্মারা নরকে নিপতিত হইবে; সুতরাং আমাকেই লোকের নরকের কারণ হইতে হইবে। অতএব এক্ষণে আমার এই প্রার্থনা যে, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া আমাকে লোকবিনাশকাৰ্য্য হইতে বিরত করুন। আমি এক্ষণে আপনার সন্তোষবিধানার্থ তপস্যা করিতে প্রস্তুত হইয়াছি।

“ব্রহ্মা কহিলেন, ‘সুন্দরি! আমি প্রজাদিগের সংহারার্থ তোমার সৃষ্টি করিয়াছি। অতএব তুমি অবিলম্বে গমন করিয়া প্রজাগণের সংহারকার্য্যে ব্যাপৃত হও। আমি যাহা বলিয়াছি, তাহা কদাচ অন্যথা হইবার নহে। অতএব তোমাকে অবশ্যই আমার বাক্যানুরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে হইবে।’ লোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা এই কথা কহিলে মৃত্যু কিছুমাত্র উত্তর প্রদান না করিয়া তাঁহার মুখাপেক্ষায় বিনীতভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন এবং কমলযোনি বারংবার তাঁহাকে প্রজানাশের অনুরোধ করাতে তিনি পরিশেষে মৃতপ্রায় হইয়া মৌনভাবে রহিলেন। লোকপিতামহ ব্রহ্মা মৃত্যুকে তদবস্থ দেখিয়া ক্রোধ পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রসন্ন হইয়া হাস্যমুখে প্রজাগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন।

ব্রহ্মশাপভীতা মৃত্যুর তপশ্চরণ

“এইরূপে ব্রহ্মার ক্রোধ শান্ত হইলে মৃত্যু প্রজাসংহার বিষয়ে অঙ্গীকার না করিয়া তাঁহার নিকট হইতে প্রস্থানপূর্ব্বক সত্বর গোতীর্থে উপস্থিত হইলেন এবং তথায় একপদে দণ্ডায়মান হইয়া পঞ্চদশপদ্ম[পনর নিযুত কোটি]সংখ্যক বৎসর অতি কঠোর তপস্যা করিলেন। তৎপরে অমিততেজাঃ ভগবান্ কমলযোনি পুনরায় তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘সুন্দরি! তুমি অতঃপর আমার বচন প্রতিপালন কর।’ তখন মৃত্যু ব্রহ্মার বাক্য শ্রবণ ও তাহাতে অনাস্থা প্রদর্শন করিয়া পুনরায় বিংশতিপদ্ম[কুড়ি নিযুত কোটি]সংখ্যক বৎসর একপদে দণ্ডায়মান রহিলেন। তৎপরে তিনি অযুতপদ্মসংখ্যক বৎসর মৃগগণের সহিত বনমধ্যে বিচরণ করিলেন এবং বিংশতি সহস্র বৎসর পর্য্যন্ত বায়ু ভক্ষণ করিয়া আট সহস্র বৎসর জলে অবস্থানপূর্ব্বক যৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন। অনন্তর তিনি কৌশিকী নদীতে গমন করিয়া তথায় জল ও বায়ু ভক্ষণপূৰ্ব্বক তপশ্চরণ করিতে লাগিলেন। তৎপর প্রজাদিগের হিতসাধনার্থ পৰ্য্যায়ক্রমে ভাগীরথীতীরে ও সুমেরুপৰ্ব্বতে গমনপূর্ব্বক স্থাণুর ন্যায় নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিলেন। তদনন্তর দেবগণ হিমালয়ের যে প্রদেশে অবস্থান করেন, সেই স্থানে গমনপূৰ্ব্বক ব্রহ্মার সন্তোষসাধনার্থ নিখর্ব্ব[দশসহস্র কোটি]সংখ্যক বৎসর অঙ্গুষ্ঠে নির্ভর করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন।

“তখন সৃষ্টিসংহারকর্ত্তা ভগবান্ ব্রহ্মা তাঁহার নিকট আগমনপূর্ব্বক তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘বৎসে! কেন আর তপানুষ্ঠান করিতেছ? আমি যাহা কহিয়াছি, অতঃপর তাহার অনুষ্ঠান কর।’ তখন মৃত্যু পুনরায় তাঁহাকে কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি প্রজাসংহার করিতে সমর্থ হইব না। আমি পুনরায় আপনাকে প্রসন্ন করিবার জন্য তপশ্চরণ করিব।’ মৃত্যু এই কথা কহিলে পিতামহ ব্রহ্মা তাঁহাকে অধৰ্ম্মভয়ে ভীত দেখিয়া কহিলেন, ‘ভদ্রে! প্রজাসংহারনিবন্ধন তোমার কিছুমাত্র অধৰ্ম্ম হইবে না। তুমি নির্ভয়ে প্রজাগণকে সংহার কর। আমি যাহা বলিয়াছি, তাহা কোনক্রমেই অন্যথা হইবার নহে। তুমি প্রজাসংহার করিয়া সনাতন ধর্ম্মলাভে সমর্থ হইবে। আমি এবং অন্যান্য দেবগণ আমরা সকলেই সৰ্ব্বদা তোমার হিতানুষ্ঠানে নিযুক্ত রহিলাম। আমি এক্ষণে তোমাকে এই এক অভিলষিত বর প্রদান করিতেছি যে, প্রজাগণ ব্যাধিপীড়িত হইয়া কলেবর পরিত্যাগ করিবে তাহারা কখনই তোমার দোষ কীৰ্ত্তন করিবে না। আর তুমি পুরুষ হইয়া পুরুষগণকে, স্ত্রী হইয়া স্ত্রীদিগকে ও ক্লীব হইয়া ক্লীবসমুদয়কে আক্রমণ করিবে।

মৃত্যুসহকারী জরাব্যাধি প্রভৃতির উদ্ভব

“দেবাদিদেব ব্রহ্মা এই কথা কহিলে, মৃত্যু কৃতাঞ্জলিপুটে পুনরায় তাঁহাকে কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি কখনই প্রজাগণকে সংহার করিতে সমর্থ হইব না।’ তখন লোকপিতামহ পুনরায় তাঁহাকে কহিলেন, ‘ভদ্রে! তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে প্রজাগণকে সংহার কর। যাহাতে তোমার অধৰ্ম্মস্পর্শ না হয়, আমি তাহার উপায়বিধান করিব। তুমি স্বীয় নয়নবিগলিত যে অশ্রুবিন্দুসমুদয় স্বহস্তে ধারণ করিয়া রহিয়াছ, সেই অশ্রুবিন্দুসকল ঘোরতর ব্যাধিরূপে পরিণত হইয়া যথাসময়ে মানবগণকে বিনাশ করিবে। তুমি জীবগণের বিনাশ সময়ে তাহাদের নিকটে কাম ও ক্রোধকে প্রেরণ করিও, তাহা হইলে তাহারাই মানবগণের বিনাশসাধক হইবে। তুমি রাগদ্বেষপরিশূন্য, সুতরাং তোমাকে অধৰ্ম্মভাগী হইতে হইবে না; প্রত্যুত তোমার ধর্ম্মলাভই হইবে। অতএব তুমি এইরূপে ধৰ্ম্মপ্রতিপালনে যত্ন কর, আপনাকে অধৰ্ম্মে পতিত করিও না। এক্ষণে স্বীয় অধিকার অবলম্বনপূর্ব্বক জীবগণকে সংহার করাই কর্ত্তব্য।’

“তখন মৃত্যু ব্রহ্মার শাপ ভয়ে ভীত হইয়া অগত্যা প্রাণীগণের সংহারসাধনে অঙ্গীকার করিলেন। সেই অবধি তিনি কামক্রোধকে প্রেরণপূর্ব্বক জীবগণকে মুগ্ধ করিয়া তাহাদিগের প্রাণসংহারকাৰ্য্য সম্পাদন করিয়া আসিতেছেন। মৃত্যুর অশ্রুপাতসকল ব্যাধিস্বরূপ। ঐ ব্যাধিপ্রভাবে মনুষ্যদিগের শরীর রুগ্ন হইয়া থাকে। অতএব প্রাণীগণের প্রাণনাশনিবন্ধন শোক করা কর্ত্তব্য নহে। জীবগণের ইন্দ্রিয়-সমুদয় যেমন সুষুপ্তিসময়ে বিরত এবং নিদ্রাভঙ্গ হইলে প্রতিনিবৃত্ত হয়, তদ্রূপ মনুষ্যগণও একবারে পরলোকগমন পূৰ্ব্বক তথা হইতে পুনরায় আগমন করিয়া থাকে। মহাতেজস্বী ভীষণ-নিনাদসম্পন্ন বায়ু সমুদয় জীবের জীবনস্বরূপ হইয়া দেহীদিগের নানাবিধ দেহে অবস্থান করিতেছে। এই নিমিত্ত বায়ুকেই ইন্দ্রিয়গণের অধীশ্বর বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। সময়ক্রমে দেবতারা মর্ত্ত্যসংজ্ঞা এবং মনুষ্যগণ দেবত্বলাভ করিয়া থাকেন। আপনার পুত্র স্বর্গে গমন করিয়া সুখে বিহার করিতেছেন, অতএব আপনি তাঁহার নিমিত্ত শোক প্রকাশ করিবেন না।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! মৃত্যু এইরূপে ভগবান্ কমলযোনি কর্ত্তৃক বিসৃষ্ট হইয়া স্বীয় অশ্রুপাতজনিত ব্যাধিসমুদয়ের সাহায্যে যথাকালে জীবগণকে সংহার করিয়া থাকেন।”