২৫৭তম অধ্যায়
সৃষ্টিসংরক্ষণে ব্রহ্মার প্রতি রুদ্রের অনুরোধ
“রুদ্র কহিলেন, “ব্রহ্মন্! আপনি প্রজাসৃষ্টি করুন, এই আমার প্রার্থনা। এই সমস্ত প্রজা আপনিই সৃষ্টি করিয়াছেন; অতএব ইহাদিগের উপর কোপ প্রকাশ করা আপনার কর্ত্তব্য নহে। হে দেব! আপনার তেজঃপ্রভাবে প্রজাগণ দগ্ধ হইতেছে; তদ্দর্শনে আমার অন্তঃকরণে অত্যন্ত করুণাসঞ্চার হইয়াছে; অতএব এক্ষণে আপনি ইহাদিগের প্রতি ক্রোধ সংবরণ করুন।
“প্রজাপতি কহিলেন, ম‘হেশ্বর! আমি প্রজাবর্গের উপর ক্রোধাবিষ্ট হই নাই। প্রজাসকল উৎসন্ন হউক, আমার এরূপ অভিলাষও নহে। আমি কেবল বসুমতীর ভার-লাঘবের নিমিত্ত প্রজাগণের বিনাশসাধনে প্রবৃত্ত হইয়াছি। এই বসুন্ধরা লোকভয়ে আক্রান্ত ও রসাতলে নিমগ্নপ্রায় হইয়া প্রজাসংহারের নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করাতে আমি কিরূপে প্রবীণ প্রজাগণকে সংহার করিব, ইহা চিন্তা করিতেছিলাম। যখন আমি ঐ বিষয় চিন্তা করিয়া বুদ্ধিবলে অবধারণ করিতে পারিলাম না, তখন আমার অন্তরে ক্রোধসঞ্চার হইল।’
‘রুদ্র কহিলেন, ‘ভগবন্! আপনি প্রসন্ন হউন; এই স্থাবর জঙ্গমাত্মক প্রজাসকল বিনাশ করিবেন না। দেখুন, এই চরাচর চতুৰ্ব্বিধ ভূত-একবারে উৎসন্ন হইয়া গেল। সমস্ত জগতে হাহাকারশব্দ উত্থিত হইয়াছে। অতএব আমি আপনার নিকট বারংবার প্রার্থনা করিতেছি, আপনি প্রসন্ন হউন। এই সমস্ত প্রজা বিনষ্ট হইলে আর প্রত্যাগত হইবে না। অতএব এক্ষণে আপনি স্বীয় তেজঃপ্রভাবেই আপনার তেজ প্রতিসংহার [দমন—নিবারণ] করুন। যাহাতে এই সকল প্রজা আর না দগ্ধ হয়, আপনি হিতাভিলাষপরবশ হইয়া তাহার উপায়বিধান করুন। আপনি আমাকে অধিদেবত্বে নিযুক্ত করিয়াছেন, যেন প্রজারা সমূলে উন্মূলিত না হয়। অতঃপর উহারা যাহাতে বারংবার মৃত্যুমুখে নিপতিত হইয়াও পুনরায় জন্মগ্রহণ করে, এরূপ উপায় করা আপনার কর্ত্তব্য।
ব্ৰহ্মাকর্ত্তৃক মৃত্যুর উৎপত্তি
“দেবদেব মহাদেব এই কথা কহিলে ভগবান্ ব্রহ্মা কৃপাপরবশ হইয়া পুনরায় আপনাতে তেজ প্রতিসংহার করিয়া ভূতগণের জন্মমৃত্যুর নিয়ম সংস্থাপন করিলেন। তিনি যখন ক্রোধসম্ভূত তেজঃ, প্রতিসংহার করেন, সেই সময় তাহার ইন্দ্রিয়সমুদয় হইতে পিঙ্গলবসনা, কৃষ্ণনয়না, দিব্যকুণ্ডলধারিণী ও দিব্যাভরণভূষিতা এক নারী প্রাদুর্ভূতা হইয়া দক্ষিণদিক আশ্রয় করিলেন। ব্রহ্মা ও রুদ্রদেব সেই কন্যাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর ভূতভাবন ভগবান্ প্রজাপতি তাঁহাকে আহ্বানপূর্ব্বক মৃত্যুনামে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘মৃত্যো! তুমি এই প্রজাসমূদয়কে পৰ্য্যায়ক্রমে বিনাশ কর। আমি রোষাবিষ্ট প্রজাদিগের বিনাশার্থই তোমাকে স্মরণ করিয়াছি। অতএব তোমাকে আমার নির্দ্দেশানুসারে কি পণ্ডিত, কি মূর্খ, সকলকেই নির্ব্বিশেষে বিনাশ করিতে হইবে। তোমাতে শ্ৰেয়োলাভ হউক। কমলমাল্যধারিণী মৃত্যু এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র অতিমাত্র দুঃখিত হইয়া অনবরত অশ্রুধারা মোচন ও করতল দ্বারা উহা ধারণ করিতে লাগিলেন।”