২৫৬তম অধ্যায়
অর্জ্জুনবধে কর্ণের প্রতিজ্ঞা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর স্তুতিপাঠকেরা রাজা দুৰ্য্যোধনকে স্তব করিতে লাগিল; অভ্যাগত লোকে তাঁহার মস্তকোপরি মাঙ্গলিক লাজাঞ্জলি [মুঠো মুঠো খই] ও চন্দনচুর্ণ নিক্ষেপ করিয়া স্তুতিবাদ করিতে আরম্ভ করিল। ভূপালেরা কহিলেন, “মহারাজ! ভাগ্যক্রমে আপনার যজ্ঞ নির্ব্বিঘ্নে সম্পন্ন হইয়াছে।” উন্মত্তেরা কহিল, “আপনার যজ্ঞ রাজা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের তুল্য হয় নাই; বলিতে কি, ইহা তাহার ষোড়শ অংশেরও উপযুক্ত নহে।” সুহৃজনেরা কহিল, “ইহার সদৃশ যজ্ঞ আর কোথাও অনুষ্ঠিত হয় নাই।”
ভ্রাতৃপরিবৃত দুৰ্য্যোধন এইরূপ প্রীতিকর বাক্য শ্রবণ করিতে করিতে পুরমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক পিতামাতার পদবন্দন, ভীষ্ম, দ্ৰোণ, বিদুর ও কৃপ প্রভৃতি নমস্যাদিগকে নমস্কার ও অনুজবর্গের প্রণাম গ্ৰহণ করিয়া বিচিত্ৰ সিংহাসনে উপবেশন করিলেন। ইত্যবসরে মহাবীর কর্ণ গাত্ৰোত্থান করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! এক্ষণে তুমি নির্ব্বিঘ্নে যজ্ঞ সম্পন্ন করিলে, কিন্তু যখন পাণ্ডবদিগকে বিনষ্ট করিয়া মহাসমারোহে রাজসূয়-যজ্ঞানুষ্ঠান করিবে, তৎকালে আমি তোমাকে সমুচিত সৎকার করিব, সন্দেহ নাই।” রাজা দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে বীর! তুমি কি সত্যই কহিতেছ, আমি দুরাত্মা পাণ্ডবদিগকে সংহার করিয়া মহাক্ৰতু রাজসূয় সম্পন্ন করিলে তুমি আমাকে সৎকার করিবে?
এই বলিয়া তিনি মহাবীর কর্ণকে আলিঙ্গন করিয়া রাজসূয়যজ্ঞের কথা উত্থাপনপূর্ব্বক পার্শ্বস্থ কৌরবদিগকে কহিলেন, “হে কৌরবগণ! আমি পাণ্ডবদিগকে বিনাশ করিয়া কবে রাজসূয়যজ্ঞানুষ্ঠান করিব?”
তখন কৰ্ণ কহিলেন, “মহারাজ! আমি অর্জ্জুনকে বিনাশ না করিয়া পাদধাবন বা জলগ্ৰহণ করিব না; আজি অবধি আসুরব্ৰত [সূরাপানত্যাগরূপ ব্ৰত] ধারণ করিব। কোন অর্থী আসিয়া আমার নিকট কোন বস্তু প্রার্থনা করিলে আমি তাহাকে কদাচ পরাঙ্মুখ করিব না।”
কর্ণের অর্জ্জুনবধ-প্রতিজ্ঞায় যুধিষ্ঠিরের উদ্বেগ
তখন ধাৰ্ত্তরাষ্ট্রেরা মহাবীর কর্ণের অর্জ্জুনবন্ধ-প্রতিজ্ঞা শ্রবণ করিয়া আক্রোশ প্ৰকাশ করিতে লাগিল এবং মনে করিল, যেন তাহারা পাণ্ডবদিগকে পরাজয় করিয়াছে। অনন্তর রাজা দুর্য্যোধন অন্যান্য মহীপালগণকে বিদায় করিয়া অনুজবর্গের সহিত স্ব স্ব বাসগৃহে প্রবেশ করিলেন।
এদিকে পাণ্ডবেরা দূতমুখে দুৰ্য্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া নিতান্ত চিন্তাসাগরে নিমগ্ন হইয়া আছেন, এই অবসরে এক দূত উপস্থিত হইয়া রাজা যুধিষ্ঠিরকে কর্ণের অর্জ্জুনবধপ্ৰতিজ্ঞা শ্রবণ করাইল। ধর্ম্মরাজ তাহা শুনিবা মাত্র মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণের একান্ত দুর্ভেদ্য কবচের বিষয় চিন্তা করিয়া সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইলেন। তখন আপনাদিগের দুর্ব্বিষহ ক্লেশপরম্পরা স্মরণ হওয়াতে তাঁহার অন্তঃকরণ হইতে শান্তিরস এককালে তিরোহিত হইয়া গেল। অনন্তর তিনি সেই দুরন্ত হিংস্র ও শ্বাপদসমাকীর্ণ দ্বৈতবন-পরিত্যাগের কল্পনা করিতে লাগিলেন। রাজা দুৰ্য্যোধন অনুজবর্গ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও কৃপাচাৰ্য্যের সহিত সমবেত হইয়া এই সসাগরা ধরা শাসন করিতে লাগিলেন। তিনি দান ও ভোগদ্বারা ধনের সার্থকতা সম্পাদন হইয়া থাকে বলিয়া প্রতিনিয়ত প্ৰাণপণে নৃপতিগণের প্রিয়সম্পাদন ও ভূরি দক্ষিণ যজ্ঞের অনুষ্ঠানদ্বারা বিপ্রদিগের তুষ্টিসাধন করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন।
ঘোষযাত্ৰাপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।