২৫৪তম অধ্যায়
বাসনাময় সংসারের মোহপাশ
“ব্যাস বলিলেন, ‘লুব্ধ ব্যক্তিরা আয়সপাশে [লৌহতুল্য কঠিন আশারূপ পাশ] জড়িত হইয়া হৃদয়স্থ কামবৃক্ষকে পরিবেষ্টনপূৰ্ব্বক ফললাভের অভিলাষে উহার উপাসনা করিয়া থাকে। ঐ মহাবৃক্ষ মোহ হইতে উৎপন্ন হয়। ক্রোধ ও অভিমান উহার স্কন্ধ; কৰ্ত্তব্যাভিলাষ উহার আলবাল [জলাধার বৃক্ষমূলের চতুর্দ্দিকে যে আইল বাঁধিয়া জল রাখা হয়]; অজ্ঞান উহার মূল; প্রমাদ উহার সেকসলিল [সেচন করার জল]; পূর্ব্বজন্মোপার্জ্জিত পাপ উহার সার; মোহ ও চিন্তা উহার ক্ষুদ্র শাখা; শোক উহার বৃহৎ শাখা ও ভয় উহার অঙ্কুর। মোহজনক পিপাসারূপ লতাসমুদয় ঐ বৃক্ষকে নিরন্তর বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। যে ব্যক্তি আয়সপাশ হইতে বিমুক্ত হইয়া ঐ বৃক্ষকে ছেদন করিতে পারেন, তিনি সুখ-দুঃখের হস্ত হইতে পরিত্রাণ প্রাপ্ত হয়েন। অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি যে ভোগ্যবিষয়দ্বারা এই বৃক্ষকে পরিবর্দ্ধিত করে, সেই বিষয়ই বিষ যেমন আতুরকে বিনাশ করে, সেইরূপ তাহাকে বিনষ্ট করিয়া থাকে। কৃতী ব্যক্তি সেই বদ্ধমূল বৃক্ষের অজ্ঞানরূপ মূল যোগবলে সমাধিস্বরূপ অসিদ্বারা বলপূৰ্ব্বক ছেদন করিবেন। যে ব্যক্তি জন্মমৃত্যুরূপ বন্ধনই কাম্যকর্ম্মের ফল বুঝিতে পারিয়া তাহা হইতে নিবৃত্ত হইতে পারেন, তাঁহাকে আর দুঃখভোগ করিতে হয় না। মহর্ষিগণ শরীরকে পুরস্বরূপ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন, বুদ্ধি উহার অধিকারিণী এবং চিত্ত ঐ বুদ্ধির অমাত্য। ইন্দ্রিয়গণ ও মন ঐ পুরের অধিবাসী; উহারা বুদ্ধির ভোগসম্পাদনার্থ কার্য্যানুষ্ঠান করিয়া থাকে। সেই পুরমধ্যে রজ ও তমনামে দুইটি দারুণ দোষ, বিদ্যমান রহিয়াছে। বুদ্ধি, চিত্ত ও ইন্দ্রিয়াদি পুরবাসিগণ সেই রজ ও তমোবিহিত সুখদুঃখাদি ভোগ করিয়া থাকে। রাজস ও তামস অহঙ্কার অবিহিতমার্গসমুৎপন্ন [অশাস্ত্রীয় উপায়ে জাত] সুখদুঃখ আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে। সেই পুরমধ্যে বুদ্ধি বিকৃত মনের সহিত তুল্যতা লাভ করিয়া কলুষিত হইয়া থাকে এবং ইন্দ্রিয়গণ সেই বিকৃত মন হইতে নিতান্ত ভীত হইয়া অস্থির হইয়া উঠে। কলুষিতা বুদ্ধি যে বিষয় হিতকর বলিয়া জ্ঞান করে, তাহা অনিষ্টফল প্রদানপূর্ব্বক বিনষ্ট হয় এবং মনও সেই বিনষ্ট বস্তু স্মরণ করিয়া যারপরনাই কাতর হইয়া উঠে। মন কাতর হইলে বুদ্ধি নিপীড়িত হয় এবং বুদ্ধির পীড়া হইলেই আত্মার দুঃখ জন্মিয়া থাকে। ফলতঃ মনই রজোগুণের সহিত সখ্যভাব সংস্থাপন করিয়া আত্মা ও ইন্দ্রিয়াদি পৌরবর্গকে গ্রহণপূৰ্ব্বক দুঃখের হস্তে সমর্পণ করে।”