২৫২তম অধ্যায়
পাণ্ডব-পরাভবার্থকর্ণের কূটমন্ত্রণা
জনমেজয় কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন! মহাত্মা পাণ্ডুতনয়গণের বনবাসকালে ধনুৰ্দ্ধর ধৃতরাষ্ট্ৰ-তনয়গণ, কৰ্ণ, শকুনি, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপাচাৰ্য্য কি কাৰ্য্য করিয়াছিলেন?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা সুযোধন পাণ্ডুতনয়গণ কর্ত্তৃক বিনিম্মুক্ত হইয়া হস্তিনানগরে আগমন করিলে পর কুরুকুলচূড়ামণি ভীষ্ম তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, “বৎস! আমি তোমার দ্বৈতবনাগমনকালে তোমাকে কহিয়াছিলাম যে, দ্বৈতীবনে গমন করা আমার সম্মত নহে। তুমি আমার বাক্য অবহেলন করিয়া তথায় গমন করিলে, শত্ৰুগণ বলপূর্ব্বক তোমাকে আক্রমণ করিল, ধর্ম্মজ্ঞ পাণ্ডবগণ অরাতিহস্ত হইতে তোমাকে বিমুক্ত করিয়াছেন, ইহাতে কি তোমার লজ্জার লেশমাত্রও হয় নাই? সূতপুত্ৰ কৰ্ণ তোমার ও তোমার সৈন্যসমূহ সমক্ষেই গন্ধর্ব্বগণের ভয়ে ভীত হইয়ারণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছিল। ইহাতে তুমি মহাত্মা পাণ্ডুতনয়গণ ও দুর্ম্মতি সূতপুত্রের পরাক্রম স্পষ্টই অবগত হইয়াছ। দুরাত্মা সূতপুত্র কি ধনুর্ব্বেদ, কি শৌৰ্য্য, কি ধর্ম্ম কিছুতেই পাণ্ডবগণের চতুর্থাংশভাগী নহে। অতএব এই কুলের বৃদ্ধির নিমিত্ত পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি করা আমার মতে শ্রেয়স্কর।’
করিতে করিতে শকুনি সমভিব্যাহারে তথা হইতে সহসা প্রস্থান করিলেন। কর্ণ ও দুঃশাসন প্রভৃতি ধনুৰ্দ্ধরগণ তাঁহাদের অনুগমন করিতে লাগিলেন। কুরুকুলাগ্রগণ্য ভীষ্ম তাঁহাদিগকে প্রস্থান করিতে দেখিয়া সাতিশয় লজ্জিত হইয়া স্বীয় ভবনাভিমুখে গমন করিলেন।
মহাত্মা ভীষ্ম স্বস্থানে গমন করিলে পর নরপতি দুৰ্য্যোধন মন্ত্রিগণসমভিব্যাহারে পুনরায় তথায় আগমনপূর্ব্বক মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। তিনি কহিলেন, “দেখ, কিরূপে আমাদের শ্রেয়োলাভ হইবে, কোন কর্ম্ম অবশিষ্ট আছে, আর সেই কাৰ্য্য কিরূপেই বা সম্পন্ন হইবে, এক্ষণে তদ্বিষয়ক পরামর্শ করি।”
কৰ্ণ কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! আমি যাহা কহিতেছি, অবধান পূর্ব্বক শ্রবণ কর। ভীষ্ম সতত আমাদের নিন্দা ও পাণ্ডবগণের প্রশংসা করিয়া থাকেন। তোমার দ্বেষ করিলেই আমার দ্বেষ করা হয়। তিনি সততই তোমার সমীপে আমার নিন্দা করেন। তিনি তোমার সমক্ষে যে পাণ্ডবগণের যশঃকীর্ত্তন ও তোমার নিন্দা করিয়াছেন, তাহা আমি কখনই সহ্য করিব না। হে রাজন! তুমি অনুমতি কর, আমি ভৃত্য, বল ও বাহন লইয়া শৈল-কাননসমবেত সমুদয় মেদিনীমণ্ডল পরাজয় করিব, বলশালী পাণ্ডবেরা চারিজনে সমুদয় মেদিনীমণ্ডল পরাজয় করিয়াছিল; আমি একাকী তাহা সম্পন্ন করিব। যে কুরুকুলাধম ভীষ্ম সতত অনিন্দ্যব্যক্তির নিন্দা ও অপ্ৰশংস্য ব্যক্তির প্রশংসা করিয়া থাকে, সে অদ্য আমার বল-বিক্রম দর্শন করিয়া আত্মাকে নিন্দা করুক। হে রাজন! তুমি অনুমতি কর, আমি আয়ুধ গ্রহণ করিয়া তোমার নিকট সত্য করিতেছি, নিশ্চয় তোমার জয়লাভ হইবে।”
নরপতি দুৰ্য্যোধন কর্ণের বচন-শ্রবণানন্তর পরামপ্রীত হইয়া কহিলেন, “অঙ্গরাজ! তুমি আমার হিতকার্য্যে নিরত হওয়াতে আমি ধন্য ও কৃতাৰ্থম্মন্য হইলাম, অদ্য আমার জন্ম সার্থক হইল। যখন তুমি সমুদয় শত্রুনিধনে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছ, তখন স্বচ্ছন্দে দিগ্বিজয়ে গমন করিতে প্রবৃত্ত হও, আর আমাকে সদুপদেশ প্রদান কর।”
মহাবীর কর্ণ ধীমান দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক এইরূপ আদিষ্ট হইয়া যাত্রিক-সমুদয়কে বহির্গত হইতে আদেশ করিলেন এবং শুভ তিথি, নক্ষত্র ও মুহূর্তে স্নাতক ও ব্রাহ্মণগণকর্ত্তৃক পূজিত হইয়া ধনুর্ব্বাণ গ্রহণ ও রথে আরোহণপূর্ব্বক বহির্গত হইলেন। তখন তাঁহার রথনির্ঘোষে সচরাচর ত্ৰৈলোক্য প্ৰতিধ্বনিত হইতে লাগিল।