২৫১. বাসনাত্যাগে ব্ৰহ্মজ্ঞান—ব্রহ্মজ্ঞানে মোক্ষ

২৫১তম অধ্যায়

বাসনাত্যাগে ব্ৰহ্মজ্ঞান—ব্রহ্মজ্ঞানে মোক্ষ

“ব্যাস কহিলেন, ‘যিনি গন্ধ ও রসাদি ভোগে অনুরাগ বা উহার প্রতি রাগদ্বেষ প্রকাশ না করেন এবং কীৰ্ত্তি ও সম্মানলাভে যাঁহাদের কিছুমাত্র বাসনা নাই, তিনিই যথার্থ ব্ৰহ্মজ্ঞ। কেবল ঋক্, যজু ও সামাদি বেদাধ্যয়ন, গুরুশুশ্রূষা ও ব্রহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠান করিলেই ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিগণিত হইতে পারা যায় না। যিনি জীবের প্রতি দয়াবান, সৰ্ব্বজ্ঞ ও সমুদয় বেদবেত্তা হইয়া মৃত্যুকে বশীভূত করিতে সমর্থ হয়েন, তিনিই যথার্থ ব্রাহ্মণ। যথার্থ বিধি পরিত্যাগ করিয়া কেবল নানাপ্রকার ভূরিদক্ষিণ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলেই ব্রাহ্মণ্যলাভ হয় না। যাঁহা হইতে কোন প্রাণী ভীত না হয়, যিনি স্বয়ং কোন প্রাণীকে ভয় না করেন, যাঁহার কিছুতেই স্পৃহা বা দ্বেষ থাকে না এবং কায়মনোবাক্যে কাহারও অনিষ্টাচরণ করেন না, তাঁহারই যথার্থ ব্ৰহ্মজ্ঞানলাভ হইয়া থাকে। ইহলোকে বিষয়বন্ধন ভিন্ন আর কোন বন্ধনই বিদ্যমান নাই। বিদ্বান্ ব্যক্তি ঘোরতর মেঘনির্ম্মুক্ত চন্দ্রমার ন্যায় ঐ বন্ধন হইতে মুক্তিলাভপূৰ্ব্বক নিষ্পাপ ও ব্রহ্মস্বরূপ হইয়া কালপ্রতীক্ষায় ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিয়া থাকেন। সাগরমধ্যে বিলীন নদীর জলরাশির ন্যায় বিষয়বাসনাসমুদয় যে ব্যক্তিতে একেবারে লীন হইয়া যায়, তিনিই মোক্ষপদলাভে সমর্থ হয়েন। বিষয়াভিলাষী ব্যক্তি কখনই মোক্ষলাভে অধিকারী হইতে পারে না। ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তির সমুদয় বাসনা পরিপূর্ণ হইয়া থাকে; কিন্তু বিষয়াভিলাষী ব্যক্তির কখনই উহা পূর্ণ হয় না; সে বাসনানিবন্ধন স্বর্গলাভ করিয়া তাহা হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া থাকে।

‘বেদ অপেক্ষা সত্য, সত্য অপেক্ষা ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ অপেক্ষা দান, দান অপেক্ষা তপস্যা, তপস্যা অপেক্ষা বৈরাগ্য, বৈরাগ্য অপেক্ষা আত্মজ্ঞান, আত্মজ্ঞান অপেক্ষা সমাধি ও সমাধি অপেক্ষা ব্ৰহ্মভাবপ্রাপ্তি উৎকৃষ্ট। শোক, সন্তাপ ও বিষয় বাসনা মনকে ক্লেশ প্রদান করিয়া থাকে; অতএব তুমি সন্তুষ্টচিত্তে মোক্ষের উপায়ভূত সত্ত্বগুণ অবলম্বন কর। যিনি বিশোক, নির্ম্মমতা, নিৰ্ম্মৎসরতা, সন্তোষ, শান্তি, প্রসন্নতা এই সকল গুণ অবলম্বন করেন, তিনিই যথার্থ জ্ঞানপরিতৃপ্ত হইয়া মোক্ষপথ লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। যাঁহারা শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন এবং বিশোকাদি ছয়গুণযুক্ত আত্মাকে অবগত হইতে পারেন, তাঁহারা পরলোকে অনায়াসেই সৰ্ব্বব্যাপী ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি জন্মমৃত্যুবিহীন স্বভাবসিদ্ধ নিৰ্ম্মল ব্রহ্মকে অবগত হইয়া অনন্ত সুখভোগে সমর্থ হয়েন। চিত্তকে স্থির করিয়া সৰ্ব্বপ্রযত্নে ব্রহ্মে সংস্থাপিত করিতে পারিলে যেরূপ সন্তোষলাভ হইয়া থাকে, অন্য কোন উপায়ে সেরূপ হইবার সম্ভাবনা নাই। যাঁহার মহিমায় উপবাসী ও দরিদ্র ব্যক্তিরাও পরিতৃপ্ত এবং আশ্রয়বিহীন ব্যক্তিরাও বলবান্ হয়, সেই পরব্রহ্মকে যিনি অবগত হইতে সমর্থ হয়েন, তিনিই যথার্থ বেদজ্ঞ। যিনি ইন্দ্রিয়দ্বার সমুদয় রোধপূৰ্ব্বক ধ্যাননিমগ্ন হইয়া অবস্থান করেন, লোকে তাঁহাকে ব্রহ্মজ্ঞ, শিষ্ট ও আত্মারাম বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে। যিনি বিষয়বাসনা ও জীবনের প্রতি পক্ষপাতপরিত্যাগপূৰ্ব্বক অতি উৎকৃষ্ট পরমাত্মতত্ত্বে সমাহিত থাকেন, তাঁহার আত্মসুখ চন্দ্রমণ্ডলের ন্যায় ক্রমশঃ পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে এবং দিবাকরের অভ্যুদয়ে গাঢ় অন্ধকারের ন্যায় দুঃখ তিরোভূত হইয়া যায়। তখন জরা ও মৃত্যু আর সেই বিষয়বাসনাবিমুক্ত কর্ম্মত্যাগী ব্রহ্মজ্ঞকে পরাভূত করিতে সমর্থ হয় না। তিনি রাগদ্বেষপরিশূন্য ও সৰ্ব্বত্যাগী হইয়া জীবিতাবস্থায় অনায়াসে ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমুদয় অতিক্রম করিয়া থাকেন। যাঁহারা এইরূপে দেহাদিভাব অতিক্রম করিয়া পরব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইতে সমর্থ হয়েন, তাঁহাদিগকে আর পুনরায় জন্মপরিগ্রহ করিতে হয় না।’ ”