২৫১তম অধ্যায়
দানব-বান্ধবগণকর্ত্তৃক দুর্য্যোধনের প্রতি সান্ত্বনা
দানবেরা কহিল, “হে রাজেন্দ্র ভরতকুলশ্রেষ্ঠ সুযোধন!! আপনি প্রতিদিন মহাবলপরাক্রান্ত শূরগণে পরিবৃত হইয়া অলৌকিক বল-বিক্রম ও সাহস প্রকাশ করিয়াছেন, এক্ষণে কি নিমিত্ত প্ৰায়োপবেশন করিলেন? দেখুন, আত্মঘাতী ব্যক্তি নিরয়গামী হয় এবং সকলে তাহার মহতী অকীর্ত্তি কীর্ত্তন করে। ভবাদৃশ বুদ্ধিমান পুরুষেরা কুলবিনাশন আত্মহত্যারূপ মহাপাপে কদাচ লিপ্ত হয়েন না, অতএব আপনি ধর্ম্ম, অর্থ, সুখ, যশ, প্রতাপ ও বীৰ্য্যবিনাশিনী এবং অরাতিকুলের আনন্দবৰ্দ্ধিনী এই দুবুদ্ধি পরিত্যাগ করুন। আপনি প্রকৃত মনুষ্য নহেন। আপনি স্বর্গীয় মহাপুরুষ, যেরূপে আপনার কলেবর নির্ম্মিত হইয়াছে, ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক তাহার যথার্থ তত্ত্ব শ্রবণ করুন।
“মহারাজ! আমরা পূর্ব্বে তপস্যা করিয়া মহেশ্বর-প্ৰসাদে আপনাকে লাভ করিয়াছি, আপনার শরীরের পূৰ্ব্বাৰ্দ্ধ বীজসমষ্টি দ্বারা নির্ম্মিত হইয়াছে, ঐ অংশ অস্ত্রশস্ত্রদ্বারা অভেদ্য। পশ্চিমকায় দেবী কর্ত্তৃক পুষ্পদ্বারা বিনির্ম্মিত, উহা নয়নগোচর করিলে রমণীজনের মন মোহিত হয়। এইরূপে ভগবান ভবানীপতি ও পার্ব্বতীকর্ত্তৃক আপনি নির্ম্মিত হইয়াছেন, অতএব আপনার শরীর মানবশরীর নহে।
“দিব্যাস্ত্ৰবিশারদ ভগদত্তপ্রমুখ মহাবলপরাক্রান্ত ক্ষত্ৰিয়গণ আপনার অরাতিকুল নিৰ্ম্মল করিবেন, অতএব আপনি বিষাদ পরিত্যাগ করুন, আপনার কিছুমাত্ৰ ভয় নাই, কেবল ভবদীয় সহায়তা করিবার নিমিত্তই দানবেরা ভূতলে অবতীর্ণ হইয়াছে। অন্যান্য অসুরগণ ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপাচাৰ্য্য প্রভৃতির শরীরে প্রবেশ করিলে তাহারা দয়াশূন্য হইয়া আপনার শক্রগণের সহিত যথাসাধ্য যুদ্ধ করিবেন। তখন তাঁহারা পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, বন্ধু, বান্ধব, শিষ্য, জ্ঞাতি, বালক ও বৃদ্ধ কাহাকেও ক্ষমা করিবেন না; দারুণ দানবাবেশবশতঃ বিমোহিত হইয়া এককালে চিরপরিচিত স্নেহে জলাঞ্জলি প্ৰদানপূর্ব্বক হৃষ্টচিত্তে সকলকেই যুদ্ধে প্রহার করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাঁহারা বিধিনির্ব্বন্ধ দৈবপ্রভাবে হতজ্ঞান হইয়া “আমি তোমাকে জীবিত থাকিতে পরিত্যাগ করিব না”, এইরূপ পরস্পর বাগযুদ্ধ, অনবরত অস্ত্রবর্ষণ, স্ব স্ব পুরুষকারপ্রকাশ ও শ্লাঘা করিতে করিতে শত্রুবিনাশে প্রবৃত্ত হইবেন, তদর্শনে মহাত্মা পাণ্ডবেরাও যুদ্ধ করিতে পরাঙ্মুখ হইবেন না; তাহা হইলে ভীষ্ম প্রভৃতি মহাবল পুরুষেরা দৈববলে পাণ্ডবগণের প্রাণসংহার করিবেন। দৈত্য ও রাক্ষসগণ ক্ষত্ৰিয়যোনিতে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছে, তাহারাই কাৰ্য্যকালে গদা, মুষল, শূল ও নানাপ্রকার অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক রণক্ষেত্রে সমুপস্থিত হইয়া আপনার শত্ৰুগণের সহিত যুদ্ধ করবে।
“হে রাজন! আপনার অন্তঃকরণে নিরন্তর যে অর্জ্জুন-ভয় জাগরকে রহিয়াছে আমরা তাহার নিরাকরণের সদুপায়বিধান করিয়াছি। পূর্ব্বনিহত নরকাসুরের আত্মা কৰ্ণমূর্ত্তি পরিগ্রহপূর্ব্বক জন্মান্তরীণ বৈর স্মরণ করিয়া কৃষ্ণার্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিয়া অর্জ্জুন ও অন্যান্য শত্রুদিগকে পরাজিত করিবেন। দেবরাজ ইন্দ্র ইহা জানিতে পারিয়া অর্জ্জুন রক্ষা করিবার নিমিত্ত কমিত্ত মহাবীর কর্ণের কুণ্ডলদ্বয় ও কবচ অপহরণ করবেন; তিন্নিমিত্ত আমরাও সংসপ্তকনামে শতসহস্ৰ দানব তথায় নিযুক্ত করিয়াছি, তাহারাই অর্জ্জুনকে নিহত করিবে, অতএব আপনি শোক পরিত্যাগ করুন। আপনি এই অখণ্ড ভূমণ্ডলের অদ্বিতীয় অধীশ্বর হইবেন; এক্ষণে বিষাদে প্রয়োজন নাই। হে রাজন! আপনার বিষাদ হইলে আমরাও বিনষ্ট হইব; পাণ্ডবেরা যেমন দেবগণের, তদ্রূপ আপনি আমাদিগের একমাত্র গতি, অতএব এই দুর্ব্যবসায় হইতে বিনিবৃত্ত হইয়া গৃহে গমন করুন; আপনার বুদ্ধি যেন কদাচ অন্যদিকে প্রবর্ত্তিত না হয়।” এই বলিয়া দানবেরা নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ মহারাজ দুৰ্য্যোধনকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক আত্মজের ন্যায় প্রবোধবাক্যে আশ্বস্ত ও তাঁহার বুদ্ধিবৃত্তি স্থিরীকৃত করিল। পরে প্রিয়বাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক ‘আপনার জয়লাভ হউক’ বলিয়া তাঁহাকে বিদায় করিল। তখন যে স্থানে তিনি প্রয়োপবেশন করিয়াছিলেন, সেই দেবতা পুনর্ব্বার তথায় তাহাকে আনয়ন করিলেন এবং যথোচিত উপচারে তাঁহার অর্চনা করিয়া গমনের অনুজ্ঞালাভপূর্ব্বক সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন।
অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন স্বপ্নকল্পিতের ন্যায় এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিলেন, “আমি পাণ্ডবগণকে পরাজয় করিব।” তৎকালে তাঁহার এইরূপ বোধ হইল, যেন মহাবীর কর্ণ ও সংসপ্তকগণ পার্থসংহারার্থ প্রস্তুত হইতেছেন। বস্তুতঃ পাণ্ডবদিগকে পরাজয় করিবার নিমিত্ত দুর্ম্মতিপরতন্ত্র দুর্য্যোধনের বলবতী আশা এইরূপে ক্ৰমে ক্ৰমে বদ্ধমূল হইতে লাগিল, মহাবীর কর্ণ মৃত নরকাসুরের আত্মকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া অর্জ্জুনসংহারে কৃতনিশ্চয় হইলেন এবং সংসপ্তকগণ রাক্ষসাবেশপ্রভাবে রজঃ ও তমোগুণে অভিভূত হইয়া অর্জ্জুন-বধে অধ্যবসায়ারূঢ় হইল। ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপ ইহাঁরা দানবাবিষ্ট হইয়া পাণ্ডবদিগের প্রতি পূর্ব্ববৎ স্নেহপ্রকাশে পরাঙ্মুখ হইলেন।
রাজা দুৰ্য্যোধন এই কথা অতি গোপনে রাখিলেন। পরদিন প্রভাতে মহাবীর কর্ণ কৃতাঞ্জলি হইয়া সহাস্যমুখে রাজা দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, “মহারাজ! জীবন পরিত্যাগ করিলে জয়লাভ হয় না, জীবিত ব্যক্তি সকল মঙ্গলেরই ভাজন হইয়া থাকেন, অতএব তুমি প্ৰাণ পরিত্যাগ করিলে কিরূপে জয় বা মঙ্গললাভ হইবে? এক্ষণে ভয়, বিষাদ বা মরণের অবসর নাই।” মহাবীর কর্ণ এই বলিয়া রাজা দুৰ্য্যোধনকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক পুনরায় কহিলেন, “মহারাজ! তুমি শয্যা হইতে গাত্ৰোত্থান কর, কি নিমিত্ত অকারণে শোক করিতেছ? স্ববীৰ্য্যপ্ৰভাবে শত্রুদিগকে একান্ত সন্তাপিত করিয়া এক্ষণে কেনই বা মরণাভিলাষী হইয়াছ? অথবা যদি অর্জ্জুনের বলবীৰ্য্যে তোমার শঙ্কা জন্মিয়া থাকে তবে সত্যই প্রতিজ্ঞা করিতেছি, ত্ৰয়োদশ বর্ষ অতীত হইলে আয়ুধ গ্রহণপূর্ব্বক সমরানল প্রজ্বলিত করিয়া অবিলম্বেই তাহাকে বধ করিব।”
তখন রাজা দুৰ্য্যোধন কর্ণ ও দৈত্যগণের প্রবোধবাক্যে এবং দুঃশাসনাদির অনবরত প্ৰণিপাতে শয্যা হইতে গাত্ৰোত্থান করিলেন। পরে দানবদিগের বাক্যানুসারে বুদ্ধি স্থির করিয়া সৈন্যগণকে নগরগমনে আদেশ প্রদান করিলে রথ-অশ্ব-মাতঙ্গ পদাতিক-সঙ্কুল সৈন্যসকল গঙ্গাপ্রবাহের ন্যায় অনবরত গমন করিতে লাগিল। তখন শ্বেতছত্ৰ, শ্বেতপতাকা ও শ্বেত চামরে শারদীয় সুবিমল নভোমণ্ডলের ন্যায় সৈন্যমণ্ডলী সুশোভিত হইয়া উঠিল। রাজা দুৰ্য্যোধন অধিরাজের ন্যায় পরমরাজশ্ৰীসম্পন্ন হইয়া শকুনি, কর্ণ ও দূত্যরত পুরুষগণের সহিত সর্ব্বাগ্রে গমন করিতে লাগিলেন।
ব্রাহ্মণগণ জয়াশীর্ব্বাদ প্রয়োগপূর্ব্বক তাঁহার স্তুতিবাদে প্রবৃত্ত হইলেন, অধীনস্থ সমস্ত লোক তথায় আসিয়া তাঁহাকে নমস্কার করিতে লাগিল। দুঃশাসন প্রভৃতি রাজ-মহোদরগণ ভূরিশ্রবা, সোমদত্ত ও বাহ্লিকের সহিত নানাবিধ হন্তী, অশ্ব ও রথে আরোহণপূর্ব্বক তাঁহার অনুসরণ করিলেন। এইরূপে ক্রমে ক্রমে তাঁহারা অল্পকালমধ্যেই স্বীয় নগরে সমুপস্থিত হইলেন।