রাবণের অনরণ্য রাজার সহিত যুদ্ধ
অগস্ত্যের কথা শুনি শ্রীরামের হাস।
কহ কহ বলি রাম করেন প্রকাশ।।
মরুত্তে জিনিয়া কোথা গেল সে রাবণ।
কহ দেখি শুনি মুনি পুরাণ-কথন।।
মুনি বলে যদি শুনে বীর তথা আছে।
তখনি রাবণ যায় দ্রুত তার কাছে।।
গিয়া কহে আমারে সত্বর দেহ রণ।
পরাজয় মানিলে না মারে দশানন।।
পরাজয় যে না মানে করি অহঙ্কার।
রাবণের ঠাঁই তার নাহিক নিস্তার।।
পুরন্দর নিজমুখে মানে পরাজয়।
পরাজয় মানিলে সংগ্রাম নাহি হয়।।
এরূপে রাবণ ভ্রমে পৃথিবী-মণ্ডলে।
অযোধ্যা জিনিতে যায় জয় জয় বলে।।
অনরণ্য নামে রাজা ছিল অযোধ্যায়।
বার্ত্তা পেয়ে দশানন তাঁর কাছে যায়।।
তব পূর্ব্বপুরুষ সে অনরণ্য নাম।
রাবণ তাঁহার কাছে চাহিল সংগ্রাম।।
লঙ্কার রাবণ আমি শুন অনরণ্য।
রণ দেহ আমারে না চাহি কিছু অন্য।।
শুনি অনরণ্য কোপে করে অহঙ্কার।
কটকেতে মিশামিশি হৈল মহামার।।
প্রাচীন বয়স রাজা মাংসে চক্ষু ঢাকে।
ভ্রূ-দ্বয় তুলিয়া বান্ধি রাজা সব দেখে।।
বহুকাল-জীবি রাজা পৃথিবী ভিতর।
রাজার বয়স বাইশ হাজার বৎসর।।
আইল রাজার সৈন্য হস্তী ঘোড়া কত।
অস্ত্র শস্ত্র আনিল রাজার ছিল যত।।
সৈন্য দুই কটক রাজার মহাবল।
রাক্ষসে মানুষে যুদ্ধ হইল প্রবল।।
অনরণ্য রাজা করে বাণ বরিষণ।
রাবণের সেনাপতি করে পলায়ন।।
সেনাপতি ভঙ্গ দেখি রাবণ ফাঁফর।
অনরণ্য সহ যুঝে ক্রোধে লঙ্কেশ্বর।।
রাবণ অসংখ্য বাণ করে বরিষণ।
বুড়া রাজা সমরে হইল অচেতন।।
আপনা সারিয়া করে বাণ বরিষণ।
বাণেতে জর্জ্জর দেহ হইল রাবণ।।
রাবণের গা বহিয়া রক্ত পড়ে ধারে।
যেমন গঙ্গার ধারা পর্ব্বত-শিখরে।।
কেহ না জিনিতে পারে, নাহি পায় আশ।
উভয়ে বরিষে বাণ নাহি ফেলে শ্বাস।।
দশানন বাণ এড়ে শূন্য হৈল তূণ।
তখন বুড়ার বাণ আছয়ে দ্বিগুণ।।
আর বাণ যাবৎ না যোগায় সারথি।
তাবৎ রাবণ মনে করিল যুকতি।।
রাবণ রাজার বুকে মারিলা চাপড়।
ভূমিতে পড়িয়া রাজা করে ধড়ফড়।।
মৃত্যুকালে বুড়া রাজা করে ছটফট।
ধাইয়া রাবণ গেল বুড়ার নিকট।।
রাজভোগে বুড়া কভু নাহি জান রণ।
আমার সহিত যুদ্ধে অবশ্য মরণ।।
জগৎ জিনিয়া ভ্রমি আপনার তেজে।
অবশ্য মরণ যে আমার সনে যুঝে।।
গর্ব্ব করে বলে রাজা মরণের কালে।
শাপ বর দিব যারে, ততক্ষণে ফলে।।
অনরণ্য বলে কিবা কর অহঙ্কার।
কভু হারি কভু জিনি রণ-ব্যবহার।।
বহু যুদ্ধ করি তুষিলাম দেবগণে।
নানারত্নে দানেতে তুষিলাম ব্রাহ্মণে।।
রাজা হয়ে করিলাম প্রজার পালন।
তিন লক্ষ দ্বিজে নিত্য করাই ভোজন।।
এ সব আমার পুণ্য জানে সবে ভালে।
তোরে যে বধিবে সে জন্মিবে মম কুলে।।
সংগ্রামে পড়িয়া রাজা গেল স্বর্গপুর।
দিগ্বিজয় করি ভ্রমে লঙ্কার ঠাকুর।।
তব পূর্ব্বপুরুষেরে জিনিল যে রণে।
সে রাবণ পড়িল শ্রীরাম তব বাণে।।
পূর্ব্বকথা শুনিয়া শ্রীরামের উল্লাস।
গাহিল উত্তরকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।