২৪৯তম অধ্যায়
নিষ্কাম কৰ্ম্মে পূৰ্ব্বকৃত সকাম কৰ্ম্মের ক্ষয়
“ব্যাস বলিলেন, ‘সত্ত্বাদি গুণ প্রকৃতির সহিত সমবেত হইয়া, ঊর্ণনাভ যেমন সূত্রের সৃষ্টি করে, সেইরূপ বিষয়সকলের সৃষ্টি করিয়া থাকে এবং আত্মা নির্লিপ্ত হইয়া সেই সমুদয় গুণে অবস্থান করেন। কেহ কেহ গুণসমুদয়ের একবার নাশ হইলেও পুনরায় উৎপত্তি হয় বলিয়া স্বীকার করেন। আর কেহ কেহ কহেন যে, গুণসমুদয় তত্ত্বজ্ঞানবলে বিনষ্ট হইলে আর উহাদের উৎপত্তি হয় না। কারণ, যদি ঐ সমুদয় গুণের পুনরুৎপত্তি হইত, তাহা হইলে তত্ত্বজ্ঞানীদিগের সেইসমুদয় গুণানুযায়ী কাৰ্য্য দেখা যাইত। জ্ঞানীলোক এই দুই মত সম্যক অবধারণপূৰ্ব্বক সিদ্ধান্ত করিয়া আত্মনিষ্ঠ হইবে। আত্মার আদি ও অন্ত নাই। মনুষ্য সেই আত্মার স্বরূপ অবগত হইয়া ক্রোধ, হর্ষ ও মৎসরতা পরিত্যাগপূর্ব্বক বিচরণ করিবে। এইরূপে দেহে আত্মাভিমান ও অনিত্য বস্তুতে শোক প্রকাশ না করিয়া অসন্দিগ্ধচিত্তে পরমসুখে অবস্থান করা কর্ত্তব্য। সন্তরণবিদ্যায় [সাঁতার কাটায়] অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা যেমন উন্নত স্থান হইতে পরিভ্রষ্ট ও গভীর স্রোতস্বতীমধ্যে নিমগ্ন হইয়া দুঃখিত হয়, সেইরূপ মনুষ্য আপনার স্বরূপ হইতে পরিচ্যুত ও সংসারসাগরে নিপতিত হইয়া অশেষ ক্লেশ স্বীকার করিয়া থাকে। আর বিচক্ষণ ও তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি যেমন স্থলে সঞ্চরণ করিয়া কদাচ দুঃখভোগ করেন না, সেইরূপ যিনি আত্মাকে সম্যক অবগত হইতে পারেন, তাহাকে কখনই ক্লেশ স্বীকার করিতে হয় না। এইরূপে মনুষ্য প্রাণীগণের সংসারে স্থিতি ও মুক্তির বিষয় এবং ঐ উভয়ের তারতম্য, সম্যক জ্ঞাত হইয়া শান্তিলাভ করিয়া থাকেন। ব্রাহ্মণের শান্তিলাভ ও আত্মজ্ঞান উপার্জ্জন করাই সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট। এই দুইটি তাঁহাদিগের মোক্ষলাভে পর্য্যাপ্ত হইয়া থাকে। এই বিষয় জ্ঞাত হইলেই লোকে শুদ্ধস্বভাব হয়; ইহা অপেক্ষা জ্ঞাতব্য আর কিছুই নাই। মনীষিগণ ইহা জ্ঞাত ও কৃতকার্য্য হইয়া মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন। পরলোকে অবিচক্ষণ ব্যক্তির যাহা যাহা ভয়জনক হইয়া উঠে, বিচক্ষণের তাহাতে কিছুমাত্র ভয় নাই। বিচক্ষণ ব্যক্তির যে সনাতন গতিলাভ হয়, তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট গতি আর কাহারও লাভ হইবার সম্ভাবনা নাই। কেহ কেহ দোষীকে নিরীক্ষণ করিয়া তাহার প্রতি অসূয়া প্রকাশ করিয়া থাকে, কেহ কেহ বা সেই দোষীকে নিরীক্ষণ করিয়া তাহার প্রতি শোকপ্রকাশ [তাহার দুঃখে দুঃখপ্রকাশ] করে; কিন্তু যাঁহারা কার্য্যাকাৰ্য্যবিচারে সমর্থ, সেই সমস্ত কুশলী ব্যক্তি কদাচ তদ্বিষয়ে শোকপ্রকাশ করেন না। নিষ্কাম কৰ্ম্ম পূৰ্ব্বকৃত সকাম কৰ্ম্ম অপনোদন করিয়া থাকে; কিন্তু যে ব্যক্তি জ্ঞানী, তাঁহার পূর্ব্বজন্মকৃত কৰ্ম্ম কদাচ প্রিয় বা অপ্রিয় সম্পাদনে সমর্থ হয় না।’ ”