২৪৮. ইন্দ্রিয়বিকারে বুদ্ধি ও আত্মার বিকার

২৪৮তম অধ্যায়

ইন্দ্রিয়বিকারে বুদ্ধি ও আত্মার বিকার

“ব্যাস বলিলেন, কর্ম্মোৎপত্তির নিয়ম তিন প্রকার। প্রথমতঃ মনোমধ্যে বিবিধ ভাবের আবির্ভাব হয়। বুদ্ধিদ্বারা সেই ভাবের নিশ্চয়জ্ঞান হইয়া থাকে। পরে অহঙ্কারপ্রভাবে উহা অনুকূল কি প্রতিকূল, তাহার উপলব্ধি হয়। ইন্দ্রিয় হইতে বিষয়, বিষয় হইতে মন, মন হইতে বুদ্ধি এবং বুদ্ধি হইতে আত্মা শ্রেষ্ঠ। যখন বুদ্ধি আত্মার সহিত অভিন্নরূপে অবস্থান করিয়া যটাদি বিবিধ স্থানের [অধিষ্ঠানের—আধারের] উৎপাদন করে, তখন উহাকে মনঃ বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়সমুদয়ের পৃথভাবনিবন্ধন এক বুদ্ধি নানাপ্রকার হইয়া থাকে। বুদ্ধি শ্রবণজ্ঞানযুক্ত হইলেই শ্রোত্র, স্পর্শজ্ঞানযুক্ত হইলেই ত্বক্‌, দর্শনজ্ঞানযুক্ত হইলেই দৃষ্টি, রসনাজ্ঞানযুক্ত হইলেই রসনা এবং ঘ্রাণজ্ঞানযুক্ত হইলেই ঘ্রাণ বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকে। এইরূপ নানাপ্রকারে বুদ্ধির বিকার উপস্থিত হয়। ঐ সমুদয় বিকারকে ইন্দ্রিয় বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। জ্ঞানময় আত্মা ঐ সকল ইন্দ্রিয়ে অধিষ্ঠান করিয়া থাকেন। বুদ্ধি মনুষ্যের দেহে তিনভাবে অবস্থানপূর্ব্বক তাহাকে কখন প্রীতিসম্পন্ন, কখন সুখদুঃখবিহীন করিয়া থাকে। তরঙ্গমালাসঙ্কুল সমুদ্র যেমন নদীর বেগ তিরোহিত করে, তদ্রূপ এই বুদ্ধি সাত্ত্বিকাদি ভাবত্রয়কে তিরোহিত করিতে সমর্থ হয়। মনুষ্য যখন কিছু প্রার্থনা করে, তখন তাহার বুদ্ধি মনোরূপে পরিণত হয়। দর্শনাদি ইন্দ্রিয়সমুদয় ভিন্ন ভিন্ন হইলেও উহাদিগকে বুদ্ধির অন্তর্ভুত বিবেচনা করা উচিত। সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়সমুদয়কে বশীভূত করা অবশ্য কর্ত্তব্য। ইন্দ্রিয় যখন বুদ্ধির সহিত অনুগত হয়, তখন ঐ স্থিরবুদ্ধি বিকৃত হওয়াতে মনোমধ্যে নানাবিধ জ্ঞানের উদয় হইয়া থাকে। আর যেমন রথ চক্রকে আশ্রয় করিয়া কাৰ্য্যসাধক হয়, তদ্রূপ সত্ত্বাদি গুণত্রয় মনঃ, বুদ্ধি ও অহঙ্কারের আশ্রয়ে কাৰ্য্যসাধন করিয়া থাকে। বিষয়নির্লিপ্ত যোগাচারপ্রবৃত্ত ইন্দ্রিয় ও উৎকৃষ্ট ধীশক্তিপ্রভাবে মনকে প্রদীপস্বরূপ করিয়া অজ্ঞানান্ধকার নিরাকৃত করা অবশ্য কর্ত্তব্য।

‘যিনি এই ভূমণ্ডলকে বুদ্ধিকল্পিত বলিয়া অবগত হইতে সমর্থ হয়েন, তাঁহাকে আর বিমুগ্ধ হইতে হয় না। তাঁহার হর্ষ, বিষাদ ও মৎসরতা একেবারে তিরোহিত হয়। যদি ইন্দ্রিয়সমুদয় বিষয়সংসর্গে লিপ্ত হয়, তাহা হইলে অশোধিতচিত্ত দুরাত্মাদিগের কথা দূরে থাকুক, পুণ্যাত্মা ব্যক্তিরাও আত্মার সহিত সাক্ষাৎকারলাভে সমর্থ হয়েন না। কিন্তু যখন মনঃপ্রভাবে সেই ইন্দ্রিয়সমুদয়কে সংযত করা হয়, তখনই প্রদীপপ্রভায় প্রকাশিত পদার্থের ন্যায় আত্মা প্রকাশিত হইয়া থাকে। জলচর পক্ষী যেমন সলিলমধ্যে সঞ্চরণ করিয়াও সলিলে নির্লিপ্ত থাকে, তদ্রূপ দেহাভিমানপরিশূন্য জ্ঞানবান্ যোগী বিষয়ভোগ-করিয়াও কখন বিষয়দোষে লিপ্ত হয়েন না। যাঁহারা পূৰ্ব্বকৃত কাৰ্য্যসমুদয় পরিত্যাগ করিয়া কেবল পরমাত্মার প্রতি অনুরক্ত হয়েন, যাঁহাদিগের বিষয়বাসনা কিছুমাত্র নাই এবং যাঁহারা সমুদয় জীবের প্রতি সমভাবে দৃষ্টি করেন, তাঁহাদিগের বুদ্ধি বিষয়বাসনা বিস্তার করিয়া কেবল জ্ঞানকেই বিস্তার করিয়া থাকে। আত্মা গুণের পরিদর্শক ও নিয়ন্তা বলিয়া গুণসমুদয় কখন আত্মাকে অবগত হইতে সমর্থ হয় না; কিন্তু আত্মা উহাদিগকে অনায়াসেই অবগত হইয়া থাকেন। প্রকৃতি ও পুরুষ এই উভয়ের এইমাত্র বিভিন্নতা যে, প্রকৃতি বিষয়সমুদয়ের সৃষ্টিবিধান করিয়া থাকেন; কিন্তু পুরুষ ঐ সমুদয়ের সৃষ্টিকার্য্যে ব্যাপৃত হয়েন না। যেমন জল ও মৎস্য, মশক ও উড়ুম্বর এবং শরমুঞ্জা ও ঈষীকা পরস্পর বিভিন্ন হইলেও একত্র মিলিত থাকে, তদ্রূপ প্রকৃতি ও পুরুষ স্বভাবতঃ স্বতন্ত্র হইলেও পরস্পর পরস্পরের সাহায্যসাপেক্ষ হইয়া একত্র অবস্থান করিয়া থাকেন।”