২৪৭. পঞ্চভূতপ্রসঙ্গে সত্ত্বাদি-গুণগত কাৰ্য্যভেদ

২৪৭তম অধ্যায়

পঞ্চভূতপ্রসঙ্গে সত্ত্বাদি-গুণগত কাৰ্য্যভেদ

“শুকদেব কহিলেন, “ভগবন্‌! অধ্যাত্ম কি পদার্থ এবং কিরূপেই বা উহার অনুষ্ঠান করিতে হয়, আপনি পুনরায় ইহা সবিস্তরে কীৰ্ত্তন করুন।

“ব্যাস কহিলেন, ‘বৎস! আমি মনুষ্যগণের অধ্যাত্মের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সাগরের তরঙ্গসমুদয় যেমন পরস্পর অভিন্ন পদার্থ হইয়াও বিভিন্ন প্রকার নিরীক্ষিত হইয়া থাকে, সেইরূপ ভূমি, জল প্রভৃতি মহাভূতসমুদয় অভিন্ন হইয়াও জরায়ুজাদি ভূতসমূহে ভিন্ন ভিন্নরূপে অবস্থান করিতেছে। কুৰ্ম্ম যেমন আপনার অঙ্গসমুদয় প্রসারিত ও সঙ্কুচিত করিয়া থাকে, সেইরূপ মহাভূতসমুদয় দেহে অবস্থানপূর্ব্বক সৃষ্টি ও সংহার করিতেছে। এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পদার্থ পঞ্চভূতময়। এই পঞ্চভূত হইতেই সৃষ্টি ও নাশ হইতেছে। ভূতস্রষ্টা ঈশ্বর সমস্ত প্রাণীতেই তারতম্যানুসারে মহাভূতসমুদয় সন্নিবেশিত করিয়া দিয়াছেন।’

“শুকদেব কহিলেন, ‘ভগবন্! মহাভূতসমুদয় যে শরীরভেদে তারতম্যানুসারে সন্নিবেশিত আছে, তাহা কি প্রকারে উপলব্ধি হইবে এবং ঐ মহাভূতসমুদয়মধ্যে কোনগুলি ইন্দ্রিয় আর কোন্‌গুলিই বা শব্দাদি গুণ, তাহাই বা কিরূপে অবগত হওয়া যায়?’

“ব্যাস কহিলেন, ‘বৎস! তুমি আমাকে যে বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে, আমি তাহা আনুপূৰ্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, অনন্যমনে শ্রবণ কর। শব্দ, শ্রোত্র ও দেহস্থ ছিদ্ৰসমুদয় আকাশগুণ; প্রাণ, চেষ্টা ও স্পর্শ বায়ুর গুণ; রূপ, চক্ষু ও জঠরাগ্নি জ্যোতির গুণ; রস, আস্বাদন ও স্নেহ সলিলের গুণ; ঘ্রেয়, ঘ্রাণ ও শরীর ভূমির গুণ। এই আমি ইন্দ্রিয়সমূহের সহিত পাঞ্চভৌতিক বিকার কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে কাহার কোন্ গুণ, তাহাও কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। স্পর্শ বায়ুর, রস সলিলের, রূপ জ্যোতির, শব্দ আকাশের ও গন্ধ ভূমির গুণ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। মন, বুদ্ধি ও পূৰ্ব্ববাসনা লিঙ্গশরীরে প্রাদুর্ভূত হয় এবং ইহারা ইন্দ্রিয়কে প্রাপ্ত হইয়া শব্দাদি গুণ গ্রহণ করিয়া থাকে। কূৰ্ম্ম যেমন আপনার অঙ্গসমুদয় প্রসারিত করিয়া পুনরায় সঙ্কুচিত করে, সেইরূপ বুদ্ধি ইন্দ্রিয়সকলকে স্ব স্ব বিষয়ে নিয়োগ করিয়া প্রত্যাহার করিয়া থাকে; বুদ্ধিপ্রভাবেই মনুষ্যের দেহে আত্মাভিমান জন্মে। বুদ্ধি শব্দাদি গুণকে প্রকাশিত ও মনের সহিত ইন্দ্রিয়সকলকে প্রবর্ত্তিত করিয়া দেয়। বুদ্ধির অভাবে শব্দাদি গুণ, মন ও ইন্দ্রিয়সমুদয় কোন কাৰ্য্যই করিতে পারে না। মনুষ্যের দেহে পাঁচ ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি ও ক্ষেত্রজ্ঞ বিরাজিত রহিয়াছেন। নেত্রাদি ইন্দ্রিয় রূপাদি বিষয়সমুদয়ের আলোচনার, মন তদ্বিষয়ক সংশয়ের ও বুদ্ধি নিশ্চয়াত্মক অনুষ্ঠানের কারণ এবং আত্মা ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির সাক্ষী। সত্ত্ব, রজ ও তম এই গুণত্রয় চিত্ত হইতে আবির্ভূত হয়। এই তিনটি গুণ সমস্ত প্রাণীতে বর্ত্তমান আছে। কাৰ্য্যদ্বারাই উহাদের পরীক্ষা হইয়া থাকে। যাহা আত্মার একান্ত প্রীতিকর, প্রশান্ত ও নিষ্পাপ বলিয়া বোধ হয়, তাহাই সত্ত্বগুণের কার্য্য। যাহা বাক্য মনের নিতান্ত সন্তাপজনক বোধ হইয়া থাকে, তাহাই রজোগুণের কার্য্য। আর যাহা মোহজালজটিল, অব্যক্তস্বরূপ, অচিন্তনীয় ও দুর্জ্ঞেয় বলিয়া অনুভূত হয়, তাহাই তমোগুণের কার্য্য। কোন নিমিত্ত বা অনিমিত্তবশতঃ যে হর্ষ, প্রীতি, আনন্দ, মমতা ও সুস্থচিত্ততা জন্মে, তাহাই সাত্ত্বিক গুণের; কোন কারণ বা অকারণে যে অভিমান, মিথ্যাবাক্য-ব্যবহার, লোভ, মোহ ও অসহিষ্ণুতা প্রাদুর্ভূত হয়, তাহাই রাজসগুণের; আর মোহ, প্রমাদ, নিদ্রা, তন্দ্রা ও জাগরণ তামসগুণের কাৰ্য্য বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। ”