২৪৬তম অধ্যায়
যৌগিক সাধনার সহজ কৌশল
“ব্যাস বলিলেন, ‘বৎস! জীবাত্মা প্রকৃতির বিকার, মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গণে যুক্ত হইয়া তাহাদিগকে পরিজ্ঞাত হইতেছেন; কিন্তু তাহারা তাঁহাকে অবগত হইতে সমর্থ হয় না। মনুষ্যেরা সারথিসঞ্চালিত পরাক্রমশালী সুশিক্ষিত উৎকৃষ্ট অশ্বসমুদয়ের ন্যায় পাঁচ ইন্দ্রিয় ও মনদ্বারা কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। ঐ সমুদয় ইন্দ্রিয় অপেক্ষা শব্দস্পর্শাদি বিষয়, বিষয় অপেক্ষা মন, মন অপেক্ষা নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি, বুদ্ধি অপেক্ষা মহত্তত্ত্ব, মহত্তত্ব অপেক্ষা অব্যক্তপ্রকৃতি ও অব্যক্তপ্রকৃতি অপেক্ষা পরব্রহ্ম শ্রেষ্ঠ; ব্রহ্ম হইতে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নাই। তিনিই সকলের প্রাপ্য বস্তু ও পরমগতি। সেই পরমাত্মা সৰ্ব্বভূতের অন্তরে গূঢ়রূপে অবস্থান করিতেছেন। তত্ত্বজ্ঞ যোগিগণ সূক্ষ্মবুদ্ধির প্রভাবেই তাঁহাকে দর্শন করিয়া থাকেন। যোগী ব্যক্তি চিন্তা ও প্রভুত্বাভিমান পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বুদ্ধির দ্বারা ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ার্থসমুদয় মহত্তত্ত্বে লীন এবং মনকে তত্ত্বদর্শিনী বুদ্ধিদ্বারা সংস্কৃত ও ধ্যানদ্বারা উপরত করিয়া স্বয়ং প্রশান্তচিত্ত হইতে পারিলেই ব্রহ্মপদলাভে সমর্থ হয়েন। যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র ও চঞ্চলচিত্ত হইয়া কামক্রোধাদিতে আত্মসমর্পণ করে, তাহাকে নিশ্চয়ই মৃত্যুমুখে প্রবিষ্ট হইতে হয়; অতএব যোগী ব্যক্তি সঙ্কল্পসমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সূক্ষ্মবুদ্ধিতে স্থূলবুদ্ধি। সন্নিবেশিত করিয়া কালঞ্জর [প্রকম্পাদিরহিত] পৰ্ব্বতের ন্যায় স্থিরপ্রকৃতি হইবেন। যোগিগণ চিত্তপ্রসাদপ্রভাবেই সমুদয় পাপপুণ্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বিশুদ্ধচিত্ত ও স্বরূপস্থ হইয়া অনন্ত সুখভোগ করিয়া থাকেন। সুষুপ্তিস্থ ব্যক্তির ন্যায় সুখদুঃখবিহীন এবং নিবাতস্থ দীপ্যমান দীপের ন্যায় নিশ্চল হওয়াই প্রসন্নচিত্ত পুরুষের লক্ষণ। যে ব্যক্তি অল্পাহারনিরত ও বিশুদ্ধচিত্ত হইয়া এইরূপে রাত্রির প্রথম ও শেষভাগে পরমাত্মার সহিত জীবাত্মার সংযোগ করেন, তিনিই জীবাত্মাতে পরমাত্মাকে দেখিতে পান।
‘হে পুত্র! এই আমি তোমাকে শিক্ষাপ্রদান করিবার নিমিত্ত ঋগ্বেদোক্ত দশসহস্র মন্ত্ররূপ সমুদ্র মন্থন করিয়া সমুদয় ধৰ্ম্মাখ্যান ও সত্যাখ্যানের সারভূত, বেদবিহিত, অলৌকিক, অনুভবগম্য, আত্মবিশ্বাসকারণ শাস্ত্রামৃত সমুদ্ধৃত করিলাম। যেমন দধি হইতে নবনীত ও কাষ্ঠ হইতে অগ্নি সমুৎপন্ন হয়, তদ্রূপ তোমার নিমিত্ত বেদশাস্ত্র হইতে এই জ্ঞান সমুদ্ধৃত হইল। স্নাতকব্রতাবলম্বী ব্যক্তিদিগকেই এইরূপ শাস্ত্র উপদেশ দেওয়া আবশ্যক। অপ্রশান্ত, অজিতেন্দ্রিয়, তপস্যাবিমুখ, বেদবিহীন, অবশীভূত, অসূয়াপরতন্ত্র, অসরল, যথেচ্ছাচারী, প্রতিকূলতর্কপরায়ণ ও কুটিল ব্যক্তিরা কখনই এই শাস্ত্রের উপযুক্ত পাত্র নহে। প্রশংসনীয়, প্রশান্ত, তপানুষ্ঠাননিরত ব্যক্তির প্রিয়পুত্র ও অনুগত শিষ্যদিগকে এই গূঢ়ধৰ্ম্মের শিক্ষাপ্রদান করা বিধেয়। অন্য ব্যক্তির নিকট উহা কীৰ্ত্তন করা কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে। তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিকে রত্নপূর্ণা পৃথিবী প্রদান করিলেও তিনি তদপেক্ষা এই জ্ঞান শ্রেষ্ঠতর বলিয়া বিবেচনা করেন। অতঃপর আমি তোমার নিকট ইহা অপেক্ষাও গুরুতর বেদনির্দ্দিষ্ট অলৌকিক আত্মতত্ত্ব কীৰ্ত্তন করিব, এক্ষণে তোমার মনে যে যে বিষয় উপস্থিত হয় এবং যেকোন বিষয়ে তোমার সন্দেহ থাকে, তৎসমুদয় আমার নিকট প্রকাশ কর।”