২৪৪তম অধ্যায়
বানপ্রস্থধৰ্ম্মনিরূপণ
ভীষ্ম কহিলেন, “অনন্তর ব্যাসদেব স্বীয় পুত্র শুকদেবকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, বৎস! যখন গৃহস্থ আপনার মাংস লোল ও কেশজাল শুভ্রবর্ণ নিরীক্ষণ করিবেন এবং যখন তাহার অপত্যের অপত্য উৎপন্ন হইবে, তখন বানপ্রস্থাশ্রম অবলম্বন করাই তাঁহার কর্ত্তব্য। বানপ্রস্থাশ্রমী আয়ুর তৃতীয় ভাগ অরণ্যমধ্যে অতিবাহিত করিবেন। এই আশ্রমে অবস্থান করিয়া গার্হপত্য প্রভূতি তিন অগ্নির পরিচর্য্যা, দেবগণের অর্চ্চনা, আহার নিয়ম, দিবসের ষষ্ঠভাগে ভোজন, অগ্নিহোত্ররক্ষা, ধেনুপ্রতিপালন, সমস্ত যজ্ঞাঙ্গের অনুষ্ঠান, অকৃষ্টপচ্য [বিনা চাষে উৎপন্ন] ধান্য, যব, নীবার ও বিঘস আহার এবং পঞ্চযজ্ঞে হবনীয় দ্রব্যসমুদয় সমর্পণ করা কর্ত্তব্য। বানপ্রস্থাশ্রমেও চারিপ্রকার বৃত্তি নির্দ্দিষ্ট আছে। তদনুসারে যজ্ঞানুষ্ঠান ও অতিথিসৎকারের নিমিত্ত কেহ কেহ এক দিনের, কেহ কেহ এক মাসের, কেহ কেহ এক বৎসরের এবং কেহ কেহ বা দ্বাদশ বৎসরের জন্য দ্রব্য সঞ্চয় করিয়া থাকেন। বানপ্রস্থেরা বর্ষাকালে বৃষ্টিবেগ সহ্য করিবেন এবং হেমন্তে সলিলমধ্যে অবস্থিত ও গ্রীষ্মের সময় পঞ্চতপা [চারিদিকে চারিটি অগ্নির কুণ্ড ও মস্তকের উপর সূৰ্য্য—এই পাঁচপ্রকার তাপের সেবনকারী] হইবেন। পরিমিত আহার, ধরাসনে শয়ন, পদাঙ্গুষ্ঠে নির্ভর করিয়া অবস্থান, ভূতলে বা আসনে উপবেশন ও তিন সন্ধ্যা স্নান করিবেন। উহাদের মধ্যে কেহ কেহ দন্ত ও কেহ কেহ প্রস্তরদ্বারা উদূখলের কাৰ্য্য সম্পাদনপূৰ্ব্বক ভক্ষণ করিয়া থাকেন। কেহ কেহ শুক্লপক্ষে, কেহ কেহ কৃষ্ণপক্ষে একবার মাত্র যবাগূ ভক্ষণ করেন, কেহ কেহ বা উহা প্রাপ্ত হইলেই ভোজন করিয়া থাকেন এবং কেহ মূল, কেহ ফল ও কেহ বা পুষ্পমাত্রদ্বারা জীবনযাত্রানিৰ্ব্বাহে প্রবৃত্ত হয়েন। বানপ্রস্থীদিগের এইরূপ ও অন্যান্যরূপ নিয়মসমুদয় নির্দ্দিষ্ট আছে।
চতুর্থাশ্রম সন্ন্যাস-নিরূপণ
‘সন্ন্যাস চতুর্থ ধৰ্ম্ম, এই ধৰ্ম্ম উপনিষদ্ হইতে প্রতিপন্ন হইয়াছে। উহাতে সকলেরই অধিকার আছে। এই দ্বাপরযুগে মহর্ষি অগস্ত্য, সৰ্ব্ববার্ষ্ণেয়, মধুচ্ছন্দ, অঘমর্ষণ, সাংকৃতি, অনিয়ত স্থানবাসী সুদিবাতণ্ডি, অহোবীৰ্য্য, কাব্য, তাণ্ড্য, মেধাতিথি, ধৰ্মনির্ব্বাক, শূন্যপাল এই সকল মহাত্মা এবং সত্যসঙ্কল্পাদি ধৰ্ম্মসম্পন্ন যাযাবরগণ এই সন্ন্যাস-ধর্ম্মের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক দেবলোকে গমন করিয়াছেন। কৃচ্ছ্র, চান্দ্রায়ণাদি অনুষ্ঠাননিরত জিতেন্দ্রিয় ধৰ্ম্মসম্পন্ন বৈখানস [বনবাসী], বালখিল্য ও সৈকতগণ [নদীতটে বালুকার উপর অবস্থানকারিগণ] এবং গ্রহনক্ষত্র ভিন্ন অন্যান্য জ্যোতিষ্কসমুদয় এবং অনেকানেক নিপুণধৰ্ম্মজ্ঞ উগ্রতপাঃ মহর্ষি বানপ্রস্থ ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়াছিলেন। জরাজীর্ণ ও ব্যাধিনিপীড়িত হইয়া শেষাবস্থায় বানপ্রস্থাশ্রম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সন্ন্যাসাশ্রম অবলম্বন করা উচিত।
‘ব্রাহ্মণ সৰ্ব্বদানসহকার একদিবসসাধ্য যজ্ঞানুষ্ঠান ও জীবিতাবস্থায় আপনার শ্রাদ্ধাদি ও পুত্ৰকলত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক আপনাতে অগ্নি বিলীন করিয়া আত্মনিষ্ঠ ও আত্মারাম হইবেন। মনুষ্যের যত দিন যোগাভ্যাসে অধিকার না জন্মে, ততদিন তাঁহার ব্রহ্মযজ্ঞ ও দর্শপৌর্ণমাসাদি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য। সন্ন্যাসী দেহত্যাগ পৰ্য্যন্ত আপনাতে গার্হপত্য প্রভৃতি তিন অগ্নি বিলীন করিয়া তাহাতে যাগ করিবেন। অন্নের নিন্দা না করিয়া যজুৰ্ব্বেদোক্ত মন্ত্র উচ্চারণপূৰ্ব্বক পাঁচ বা ছয় গ্রাস ভোজন করিবেন। বনপ্রস্থানবিধিনির্দ্দিষ্ট কৰ্ম্মপ্রভাবে পবিত্র হইয়া কেশ ও লোমমুণ্ডন এবং নখচ্ছেদনপূর্ব্বক চতুর্থ আশ্রম অবলম্বন করা বানপ্রস্থীদিগের কর্ত্তব্য। যে ব্রাহ্মণ সকলকে অভয়দানপূর্ব্বক সন্ন্যাস অবলম্বন করেন, তাঁহার তেজোময় লোকসমুদয় লাভ হয় এবং তিনি দেহান্তে পরমব্রহ্ম প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। সুশীল, নিষ্পাপ, আত্মজ্ঞানসম্পন্ন পুরুষ ইহলোক বা পরলোকের নিমিত্ত কোন কার্য্যেরই অনুষ্ঠান করেন না। তিনি ক্রোধ, মোহ ও সন্ধিবিগ্রহশূন্য হইয়া উদাসীনের ন্যায় অবস্থান করিয়া থাকেন। যিনি অহিংসা প্রভৃতি সংযম ও স্বাধ্যায় প্রভৃতি নিয়মপালনে অপরাঙ্মুখ হয়েন এবং যিনি সন্ন্যাসবিধি অনুসারে আত্মান্বেষণ ও যজ্ঞোপবীত নিক্ষেপ করেন, সেই আত্মজ্ঞ ব্যক্তির সদা বা ক্রমশঃ মুক্তিলাভ হইয়া থাকে। ধর্ম্মপরায়ণ জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির মুক্তিলাভে সংশয় কি? হে বৎস! এক্ষণে বিবিধ সদ্গুণবিভূষিত অত্যুৎকৃষ্ট চতুর্থ আশ্রমের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।”