২৪৪তম অধ্যায়
অর্জ্জুনসহ গন্ধৰ্ব্বগণের তুমুল যুদ্ধ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর দিব্যাস্ত্ৰসম্পন্ন হেমমাল্যধারী গন্ধর্ব্বেরা নিশিত শরবর্ষণদ্বারা চারিদিক আচ্ছন্ন করিল। পাণ্ডব-চতুষ্টয় ও সহস্ৰ সহস্ৰ গন্ধর্ব্ব সমবেত হইয়া ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন; তাহা দেখিয়া সকলেই নিতান্ত আশ্চৰ্য্য জ্ঞান করিল। পূর্ব্বে গন্ধর্ব্বেরা শরবৃষ্টিদ্বারা কর্ণ ও ধৃতরাষ্ট্ৰতনয়ের রথ যেমন বারংবার ছিন্ন-ভিন্ন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ পাণ্ডবচতুষ্টয়ের বর্ম্মও ছিন্ন-ভিন্ন করিলেন; পাণ্ডবেরাও শত শত গন্ধর্ব্বদিগকে মুহুর্মুহু শরবিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন গগনচারী গন্ধর্ব্বেরা ক্ষতবিক্ষতদেহ হইয়া কোনক্রমেই তাঁহাদিগের সম্মুখীন হইতে পারিলেন না।
অনন্তর বিলমদমত্ত ক্রোধাবিষ্ট অর্জ্জুন ক্ৰোধপরায়ণ গন্ধর্ব্বগণকে লক্ষ্য করিয়া দিব্যাস্ত্ৰজাল প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিলে সহস্ৰ সহস্ৰ গন্ধৰ্ব্ব যমভবনে গমন করিল। পরে মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন নিশিত শরনিকর-প্রহারে শত শত গন্ধর্ব্বকে সংহার করিতে লাগিলেন। মাদ্রীতনয় নকুল ও সহদেবও যুদ্ধে অগ্রসর হইয়া শত্রু-সংহারে প্রবৃত্ত হইলেন।
অনন্তর গন্ধর্ব্বগণ শরাঘাতে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগকে গ্রহণপূর্ব্বক গগনমার্গে উত্থিত হইল। তখন মহাবীর অর্জ্জুন শরপ্রয়োগপূর্ব্বক গন্ধর্ব্বদিগকে সমাচ্ছন্ন করিলে তাহারা পঞ্জরমধ্যগত শকুন্তের ন্যায় শরজালদ্বারা বদ্ধ হইয়া ক্ৰোধাভরে অর্জ্জুনের প্রতি অনবরত গদা ও শক্তি বর্ষণ করিতে লাগিল। অর্জ্জুন সেই শরজাল নিবারণ করিয়া গন্ধর্ব্বগণের প্রতি ভল্লাস্ত্র প্রয়োগ করিলে তদ্দ্বারা কাহার মস্তক, কাহার বা চরণ, কাহার বা বাহু শিলাবৃষ্টির ন্যায় নিরন্তর ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। উহা দেখিয়া গন্ধর্ব্বগণের অন্তঃকরণে সাতিশয় ভয়সঞ্চার হইল। তখন তাহারা অন্তরীক্ষ হইতে ভূতলস্থ অর্জ্জুনের প্রতি অনবরত শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। অর্জ্জুন তাহাদিগের অস্ত্ৰজাল নিবারণ করিয়া পুনরায় অস্ত্রপ্রয়োগপূর্ব্বক তাহাদিগকে বিদ্ধ করিলেন।
পরে তিনি স্থূলকৰ্ণ, ইন্দ্রজাল, সৌর, আগ্নেয় ও সৌম্য অস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন। যাদৃশ্য দৈত্যগণ দেবরাজ ইন্দ্রের অস্ত্ৰে নিতান্ত ব্যাকুল হইয়াছিল, তদ্রূপ গন্ধর্ব্বেরা অর্জ্জুন-বাণে একান্ত দহ্যমান হইয়া উঠিল। তাহারা যখন উদ্ধে উত্থিত হয়, তখন অর্জ্জুন বাণপ্রয়োগদ্বারা তাহাদিগকে নিবারণ করিলেন, পরে তাহারা ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে লাগিল দেখিয়া ভল্লাস্ত্ৰদ্বারা তাহাদের গতিরোধ করিলেন।
যুদ্ধাবসানে অর্জ্জুনমিত্ৰ চিত্ৰসেনের আত্মপ্রকাশ
অনন্তর গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ৰসেন গন্ধর্ব্বগণকে নিতান্ত ত্ৰাসিত ও ভীত দেখিয়া এক আয়সী গদা গ্রহণপূর্ব্বক অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইলেন। এই অবসরে অর্জ্জুন শরসমূহদ্বারা তদীয় হস্তস্থিত গদা সপ্তধা ছেদন করিলেন। তখন চিত্ৰসেন বিদ্যাপ্রভাবে প্রচ্ছন্ন হইয়া অর্জ্জুনের সহিত তুমুল সংগ্রাম করিতে লাগিলেন এবং দিব্যাস্ত্ৰজাল বিস্তারপূর্ব্বক অর্জ্জুনকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। অর্জ্জুন অস্ত্ৰদ্বারা তাহার অন্ত্র নিবারণ করিয়া পুনরায় অস্ত্র প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। কিন্তু চিত্ৰসেন মায়াবলে প্রচ্ছন্ন রহিয়াছেন বলিয়া তাঁহার অস্ত্রপ্রয়োগসকল ব্যর্থ হইল।
মহাবীর অর্জ্জুন অস্ত্রপ্রয়োগ ব্যর্থ হইল দেখিয়া ক্ৰোধে একান্ত অধীর হইয়া আকাশগামী দিব্যাস্ত্র মন্ত্রপূত করিয়া নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন এবং অন্তর্হিত ব্যক্তির বন্ধসাধন করিবার নিমিত্ত শব্দভেদী বাণ প্রয়োগ করিলেন। গন্ধর্ব্বরাজ পাৰ্থ শরাঘাতে নিতান্ত পীড়িত ও তৎক্ষণাৎ তাঁহার সমক্ষে আবির্ভূত হইয়া কহিলেন, “হে অর্জ্জুন! আমি তোমার প্রিয়সখা চিত্ৰসেন।” তখন অর্জ্জুন যুদ্ধকাতর প্রিয়সখা চিত্রসেনকে সন্দর্শন করিয়া অস্ত্রসংহার করিলেন। তদর্শনে অন্যান্য পাণ্ডবগণও বেগগামী স্বীয় তুরঙ্গম, শর ও ধনু সকল প্রতিসংহার করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর তাঁহারা পরস্পর কুশল জিজ্ঞাসা করিয়া, রথারূঢ় হইলেন।