২৪২তম অধ্যায়
গুরুসেবাদিদ্বারা জ্ঞানের উন্মেষ-উপায়
“শুকদেব কহিলেন, ‘তাত! আপনি মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার ও শব্দাদি বিষয়সংযুক্ত ইন্দ্রিয়সমুদয় ঈশ্বরের সৃষ্ট এবং অন্যান্য সমুদয় পদার্থ বুদ্ধিপ্রভাবে কল্পিত বলিয়া কীৰ্ত্তন করিলেন। এক্ষণে ইহলোকে সাধুব্যক্তিরা যুগে যুগে যেরূপ সদ্ব্যবহার অনুসারে অবস্থান করিয়া থাকেন, আমি তাহা শ্রবণ করিতে অভিলাষী হইয়াছি। আর বেদবচনে কৰ্ম্মানুষ্ঠান ও কর্ম্মপরিত্যাগ উভয়েরই বিধান রহিয়াছে; অতএব ঐ উভয়ের মধ্যে কি কৰ্ত্তব্য ও কি অকৰ্ত্তব্য, তাহা কিরূপে নির্ণয় করা যাইবে? এক্ষণে আপনি বিস্তারিতরূপে ঐ সমুদয় কীৰ্ত্তন করুন। আমি আপনার উপদেশলাভে পবিত্র ও লোকাচারসমুদয় বিশেষ অবগত হইয়া স্বীয় বুদ্ধিসংস্কার করিয়া দেহাভিমান পরিত্যাগপূর্ব্বক জীবাত্মার সহিত সাক্ষাৎকার করিব।
“বেদব্যাস কহিলেন, বৎস! পূৰ্ব্বে ভগবান্ স্বয়ম্ভূ যেরূপ বৃত্তি বিধান করিয়া দিয়াছেন, পূর্ব্বতন ঋষিরা সেইরূপ আচারব্যবহার করিয়া গিয়াছেন। মহর্ষিগণ মনে মনে আপনাদের শ্ৰেয়োলাভবাসনায় ব্রহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া লোকসমুদয় পরাজয় করেন। যিনি ফলমূলাহারী, অতি কঠোর তপানুষ্ঠাননিরত, পুণ্যস্থানসঞ্চারী [পূর্ণমনোরথ] ও অহিংসাপরায়ণ হয়েন এবং বানপ্রস্থদিগের কুটীর মুষলশব্দপরিশূন্য ও ধূমবিরহিত হইলে তথায় ভিক্ষাৰ্থ গমন করেন, তিনিই ব্রহ্মপদ লাভ করিতে পারেন। অতএব তুমি অন্যের স্তুতি ও নমস্কার এবং শুভাশুভ প্রভৃতি সমুদয় বিষয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক একাকী অরণ্যে গমনপূর্ব্বক কথঞ্চিৎ জীবিকা নিৰ্ব্বাহ করিয়া স্বেচ্ছানুসারে বিচরণ কর।
“শুকদেব কহিলেন, “তাত! কর্ম্মের অনুষ্ঠান কর্ত্তব্য ও কৰ্ম্মত্যাগ করা কর্ত্তব্য, এই দুই বেদবাক্য পরস্পর বিরুদ্ধ; অতএব ঐ বাক্যদ্বয়ের শাস্ত্ৰত্বসিদ্ধি কিরূপে হইবে? এক্ষণে আপনি ঐ দুই বাক্যের সপ্রমাণতা প্রদর্শন এবং যেরূপে কৰ্ম্মানুষ্ঠানের অবিরোধে মোক্ষ লাভ করা যায়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।’
“মহাত্মা শুকদেব এই কথা কহিলে, ভগবান্ বেদব্যাস তাঁহার বাক্যের প্রশংসা করিয়া কহিলেন, ‘বৎস! কি ব্রহ্মচারী, কি গৃহস্থ, কি বানপ্রস্থ, কি ভিক্ষুক ইহাদিগের মধ্যে যিনি কামদ্বেষশূন্য হইয়া শাস্ত্রানুসারে ব্যবহার করেন, তিনিই পরমগতি লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। চারি আশ্রমের সোপান ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। সেই সোপানে আরোহণ করিলেই ব্রহ্মলোকে গমন করা যাইতে পারে।
গুরুসেবার বিধিবর্ণন
‘ধর্ম্মার্থকোবিদ ব্রহ্মচারী ঈর্য্যাশূন্য হইয়া গুরু বা গুরুপুত্রের নিকট জীবনের চতুর্থ ভাগ অতিবাহিত করিবেন। তাঁহার গুরুগৃহে অবস্থানকালে গুরুর শয়নের পর শয়ন ও তাঁহার গাত্রোত্থানের পূৰ্ব্বে গাত্রোত্থান করিয়া শিষ্য বা দাসজনোচিত কাৰ্য্যসমুদয় সম্পাদন ও তাঁহার পার্শ্বে অবস্থান করা কর্ত্তব্য। কাৰ্য্যসমুদয় সুসম্পন্ন হইলে গুরুর নিকটে অবস্থানপূর্ব্বক অধ্যয়ন করা উচিত। তিনি সর্ব্বদা সরলস্বভাব ও অপবাদশূন্য হইয়া থাকিবেন এবং আচাৰ্য্য আহ্বান করিবামাত্র তথায় গমন করিবেন। কিঞ্চিৎ দূরে অবস্থান করিয়া অনাকুলিতলোচনে [নেত্রে ব্যাকুলতার চিহ্নহিতভাবে] গুরুকে অবলোকন ও তাঁহার সহিত কথোপকথন করা জিতেন্দ্রিয় গুণবান শিষ্যের বিধেয়। আচার্য্য ভোজন না করিলে ভোজন, পান না করিলে পান, উপবেশন না করিলে উপবেশন এবং শয়ন না করিলে শয়ন করা কৰ্ত্তব্য নহে। উত্তানপাণি [চিৎহস্ত] হইয়া মৃদুভাবে দক্ষিণহস্তদ্বারা গুরুর দক্ষিণপাদ এবং বামহস্তদ্বারা তাঁহার বামচরণ স্পর্শ করা কর্ত্তব্য।
‘ব্রহ্মচারী আচাৰ্য্যকে অভিবাদন করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিবেন—“ভগবন্! আমাকে শিক্ষা প্রদান করুন; আমি এই কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছি এবং এই এই কার্য্যের অনুষ্ঠান করিব; আর আপনি যাহা অনুষ্ঠান করিতে অনুমতি প্রদান করিবেন, এক্ষণে তাহাও সম্পাদন করিতে প্রস্তুত আছি।” গুরুভক্তিপরায়ণ ব্রহ্মচারী এইরূপে গুরুকে সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিয়া সমুদয় কার্য্য শেষ হইলে পুনরায় তাঁহাকে তদ্বিষয় বিজ্ঞাপিত করিবেন। ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচর্য্যসময়ে সমুদয় রস ও গন্ধসেবন পরিত্যাগ করিয়া থাকেন, সমাবর্ত্তনের পর তাঁহার সেই সকল ব্যবহার করা ধৰ্ম্মানুগত। শাস্ত্রে ব্রহ্মচারীর যেসমুদয় নিয়ম নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, তাঁহার নিয়ত সেই সমুদয়ের আচরণ করা এবং আচার্য্যের বশবর্তী হওয়া অবশ্য কর্ত্তব্য। তিনি এইরূপে সাধ্যানুসারে গুরুর প্রীতিসাধন করিয়া আশ্ৰমান্তরে গমন করিবেন। বেদাধ্যয়ন ও উপবাসাদিদ্বারা গুরুগৃহে জীবনের চতুর্থ ভাগ গত হইলে আচাৰ্য্যকে দক্ষিণা দান করিয়া যথাবিধানে গুরুগৃহ হইতে সমাবৃত্ত হইবেন এবং তৎপরে গৃহস্থধৰ্ম্ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মপত্নীসমভিব্যাহারে বহ্নি সংস্থাপন করিয়া ব্রতচৰ্য্যাদ্বারা জীবনের দ্বিতীয় ভাগ অতিবাহিত করিবেন। ”