২৪০তম অধ্যায়
গন্ধর্ব্বসহ দুৰ্য্যোধনাদির যুদ্ধ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! অনন্তর গন্ধর্ব্বগণ যাহা যাহা কহিয়াছিল, সেনানায়কেরা সকলে একত্ৰ হইয়া দুৰ্য্যোধনসমীপে তৎসমুদয় নিবেদন করিল। প্রতাপবান দুৰ্য্যোধন, গন্ধর্ব্বেরা তাঁহার সেনাগণকে নিবারণ করিয়াছে শুনিয়া যৎপরোনাস্তি ক্রোধান্বিত হইয়া তাহাদিগকে কহিলেন, “হে সৈন্যগণ! তোমরা সত্বর গমন করিয়া সেই অধার্ম্মিক বিপ্রকারী গন্ধর্ব্বগণকে শাসন কর। যদি সুররাজ শতক্রতু সমুদয় দেবগণসমভিব্যাহারে আসিয়া তাহাদের সাহায্য করেন, তথাপি তোমরা কিছুমাত্র শঙ্কা করিবে না।” দুৰ্য্যোধনের এইরূপ বচন-শ্রবণানন্তর যাবতীয় ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ ও সহস্ৰ সহস্ৰ যোদ্ধা বদ্ধপরিকর হইয়া সিংহনাদে দশদিক পরিপূর্ণ করিয়া বলপূর্ব্বক সেই বনে প্রবেশ করিতে লাগিল। তখন অন্যান্য গন্ধর্ব্বগণ সাত্ত্বনাবাদপূর্ব্বক তাহাদিগকে নিষেধ করিলেও তাহাদের বাক্য অনাদর করিয়া বনে প্ৰবেশ করিল।
গন্ধর্ব্বগণ যখন দেখিল যে, দুৰ্য্যোধনপ্রমুখ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ কোনক্রমেই বাক্যে নিবারিত হইবার নহে, তখন তাহারা সকলে সমবেত হইয়া গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ৰসেনের নিকট গমনপূর্ব্বক ঐ সমস্ত অত্যাচার নিবেদন করিল। তিনিও তখন ক্ৰোধে অধীর হইয়া সমাগত সেনাগণকে আদেশ করিলেন, “তোমরা শীঘ্ৰ গিয়া সেই অনাৰ্য্যগণকে শাসন কর।”
গন্ধর্ব্বগণ চিত্ৰসেনের অনুজ্ঞাপ্ৰাপ্তিমাত্র অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণের সহিত সংগ্রাম করিতে ধাবমান হইল। কুরুসৈন্যেরা গন্ধর্ব্বগণকে বেগে ধাবমান দেখিয়া দুৰ্য্যোধনের সমক্ষেই পলায়ন করিতে লাগিল। কিন্তু মহাবীর কর্ণ তাহাদিগকে পলায়নপরায়ণ দেখিয়াও রণে পরাঙ্মুখ হইলেন না। তিনি ক্ষুরপ্রবিশিখ, ভল্ল, বৎসদণ্ড ও অন্যান্য অয়োময় নিশিত শরবর্ষণপূর্ব্বক শত শত গন্ধৰ্ব্বগণের প্রাণসংহার করিতে লাগিলেন; নিশিত সায়কনিক্ষেপদ্বারা এককালে অসংখ্য গন্ধৰ্ব্বগণের মস্তক ধরাতলে পাতিত করিয়া তাহাদিগকে ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলিলেন। কর্ণকর্ত্তৃক আহত গন্ধর্ব্বগণ শতসহস্ৰ সংখ্যায় একত্র হইয়া পুনরায় আগমন করিল; চিত্ৰসেনের সেনাসমাগমে পৃথিবীতল মুহূর্ত্তমধ্যেই গন্ধর্ব্বগণে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
তখন রাজা দুৰ্য্যোধন, শকুনি, দুঃশাসন ও বিকৰ্ণ প্রভৃতি অন্যান্য ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ গভীরনিঃস্বন রথে আরোহণপূর্ব্বক কৰ্ণকে অগ্রসর করিয়া গন্ধর্ব্বসেনার উপর পুনরায় শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। গন্ধর্ব্বগণও তাঁহাদিগের প্রতি শর-সমূহ নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে ক্রমে ক্ৰমে তুমুল সংগ্রাম সমুপস্থিত হইলে কিয়ৎক্ষণ পরে গন্ধর্ব্বগণ কৌরবদিগের শরে পীড়িত ও নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িল। তদ্দর্শনে কৌরবগণ আনন্দিতচিত্তে গর্ব্বভরে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিল।
চিত্ৰসেন গন্ধৰ্বের আগমন—যুদ্ধে কর্ণের পলায়ন
তখন গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ৰসেন গন্ধর্ব্বগণকে বিত্ৰাসিত দেখিয়া ক্ৰোধকম্পিত্যকলেবরে কৌরবগণকে বধ করিবার মানসে আসন হইতে গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক যুদ্ধক্ষেত্রে সমাগত হইলেন এবং মায়ান্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক ঘোরতর সংগ্ৰাম করিতে লাগিলেন। কৌরবসেনাগণ চিত্ৰসেনের বিচিত্ৰ মায়ায় মুগ্ধ হইল। তখন দশ দশ জন গন্ধর্ব্বসেনা এক এক জন কৌরবসৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলে তাহারা শক্রগণের প্রহারে সাতিশয় পীড়িত হইয়া রণ পরিত্যাগপূর্ব্বক উৰ্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিতে লাগিল।
এইরূপে দুৰ্য্যোধনের সেনা-সমুদয় ভীত হইয়া পলায়ন করিলেও মহাবীর কর্ণ পর্ব্বতের ন্যায় স্থিরতরভাবে দণ্ডায়মান ও ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ হইয়া দুৰ্য্যোধন ও শকুনিকে সহায় করিয়া গন্ধর্ব্বগণের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন সহস্ৰ সহস্র গন্ধর্ব্বগণ একত্ৰ হইয়া কৰ্ণকে সংহার করিবার মানসে অসি, পট্টিশ, শূল, গদা প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক ধাবমান হইয়া চতুর্দ্দিক হইতে নিক্ষেপ করিতে লাগিল, এবং কেহ কেহ তাঁহার রথের যুগকাষ্ঠ কেহ কেহ বা ধ্বজ, কেহ কেহ ঈশা, কেহ কেহ বা অশ্বগণকে, কেহ কেহ সারথিকে, কেহ কেহ বা রথগুপ্তি, কেহ কেহ বা রথবন্ধন ছেদনপূর্ব্বক তাঁহার রথ তিল তিল করিয়া খণ্ড খণ্ড করিল। তখন কৰ্ণ নিতান্ত নিরুপায় হইয়া অসিচর্ম্ম ধারণপূর্ব্বক রথ হইতে ভূতলে অবতীর্ণ হইলেন এবং আত্মত্রাণের নিমিত্ত সত্বর বিকর্ণের রথে আরোহণ করিয়া স্বহস্তে অশ্বচালনপূর্ব্বক পলায়ন করিলেন।