২৩তম অধ্যায়
বান্ধবগণকর্ত্তৃক কীচকসহ দ্রৌপদীর বন্ধন–সৎকারার্থ শ্মশানগমন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ইত্যবসরে কীচকের বন্ধুগণ তথায় সমুপস্থিত হইয়া তাহার চতুর্দ্দিকে উপবেশনপূর্ব্বক রোদন করিতে লাগিল। তাহারা স্থলে সমুদ্ধৃত কূর্ম্মের ন্যায় সম্ভিন্নকলেবর কীচককে নিরীক্ষণ করিয়া একান্ত ভীত ও রোমাঞ্চিত হইল। অনন্তর তাহার ঔদ্ধদেহিক ক্রিয়াকলাপ নির্ব্বাহ করিবার নিমিত্ত তদীয় মৃতদেহ বহির্দেশে নিষ্কাশিত করিবার উপক্ৰম করিতেছে, এই অবসরে উপকীচকেরা অনতিদূরে দ্রৌপদীকে অবলোকন করিল।
তখন তাহারা সমাগত অন্যান্য ব্যক্তিদিগকে কহিল, “হে বান্ধবগণ! যাহার নিমিত্ত আমাদিগের কীচক বিনষ্ট হইয়াছেন, ঐ দেখ, সেই অসতী স্তম্ভ আলিঙ্গনপূর্ব্বক দণ্ডায়মান রহিয়াছে। উহাকে শীঘ্ৰ বিনষ্ট কর অথবা এক্ষণে উহাকে সংহার করিবার আবশ্যক নাই, কামী কীচকের সহিত উহার কলেবর ভস্মসাৎ করা উচিত। কারণ, লোকান্তরেও কীচকের প্রিয়ানুষ্ঠান করা আমাদিগের কর্ত্তব্য।” এই বলিয়া তাহারা বিরাটের নিকট সমুপস্থিত হইয়া কহিল, “মহারাজ! পাপীয়সী সৈরিন্ধ্রীর নিমিত্তই আমাদিগের কীচক বিনষ্ট হইয়াছেন; অতএব আমরা উহাকে তাঁহার সহিত দগ্ধ করিব; আপনি অনুমতি প্ৰদান করুন।” বিরাটরাজ উপকীচকগণের বলবিক্রম বিশেষরূপে অবগত ছিলেন, সুতরাং তাঁহাদের বাক্য শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ভীত হইয়া তদ্বিষয়ে অনুমোদন করিলেন।
তখন উপকীচকেরা দ্রৌপদীর সম্মুখীন হইয়া তাহাকে বলপূর্ব্বক গ্রহণ ও বন্ধন করিয়া কীচকের মৃতদেহোপরি আরোপিত করিয়া শ্মশানাভিমুখে গমন করিতে লাগিল। দ্রৌপদী প্রাণভয়ে নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া শরণা লইবার নিমিত্ত করুণস্বরে কহিতে লাগিলেন, “জয়, জয়ন্ত, বিজয়, জয়ৎসেন ও জয়দ্বল, ইহারা এক্ষণে আমার কথায় কৰ্ণপাত করুন। সূতপুত্রেরা আমাকে শ্মশানে লইয়া যাইতেছে। রণস্থলে যাঁহাদিগের বীজনির্ঘোষসদৃশ ধনুষ্টঙ্কার, তরবারিধ্বনি ও ভয়ঙ্কর রথঘর্ঘরশব্দ শ্রুত হইত। সেই সকল গন্ধর্ব্বগণ এক্ষণে আমার কথায় কৰ্ণপাত করুন। সূতপুত্রেরা আমাকে শ্মশানে লইয়া যাইতেছে।”
ভীমকর্ত্তৃক কীচক-বান্ধব বধ—দ্রৌপদী-মোচন
তখন ভীমসেন দ্রৌপদীর এইরূপ করুণ-বিলাপ। শ্রবণ করিবামাত্র সত্বর শয্যা হইতে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক কহিলেন, “হে সৈরিন্ধ্রী! তোমার বাক্য কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইয়াছে; এক্ষণে আর তোমার কোন শঙ্কা নাই।” এই বলিয়া ভীমসেন সমস্ত উপকীচক— সংহারার্থ প্ৰস্তুত হইয়া বেশপরিবর্ত্তন করিলেন। পরে নিগমদ্বার পরিহারপূর্ব্বক অন্যস্থান দিয়া বহিঃপ্রদেশে নিষ্ক্রান্ত হইলেন এবং সত্বর নগরপ্রাকার উল্লঙঘনপূর্ব্বক দ্রুতপদসঞ্চারে শ্মশানাভিমুখে ধাবমান হইতে লাগিলেন।
তিনি কিয়ৎক্ষণ পরে শ্মশানভূমিসমীপে সূতপুত্ৰগণের নিকট সমুপস্থিত হইলেন। তথায় দশব্যাম-আয়ত তালপ্রমাণ এক বনস্পতি নিরীক্ষণ করিয়া ভূজদণ্ডদ্বারা তাহা উৎপাটনপূর্ব্বক উদ্যতদণ্ড সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় সূতপুত্রদিগের প্রতি ধাবমান হইলেন। তাঁহার গমনবেগে ন্যাগ্রোধ, অশ্বথ ও কিংশুক প্রভৃতি বৃক্ষসকল অনবরত ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল।
তখন ভীমসেন ক্ৰমে সূতপুত্ৰগণের দৃষ্টিপথে নিপতিত হইলেন। তাহারা কুপিত সিংহসদৃশ বৃকোদরকে গন্ধর্ব্ব জ্ঞান করিয়া বিষাদসাগরে নিমগ্ন ও প্রাণভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া পরস্পর কহিতে লাগিল, “ঐ দেখ, মহাবল পরাক্রান্ত গন্ধর্ব্ব ক্ৰোধাভরে পাদপ উদ্যত করিয়া আগমন করিতেছেন; অতএব যাহার নিমিত্ত আমাদিগের এই ভয় উপস্থিত হইয়াছে, সেই সৈরিন্ধ্রীকে শীঘ্র পরিত্যাগ কর।” এই বলিয়া তাহারা দ্রৌপদীকে পরিত্যাগপূর্ব্বক নগরাভিমুখে ধাবমান হইল। তখন পবন-তনয় ভীমসেন সূতপুত্রদিগকে ধাবমান দেখিয়া ক্রোধাভরে বৃক্ষপ্ৰহারপূর্ব্বক দেবরাজ যেমন অসুরগণকে নিপাত করেন, তদ্রূপ সেই একশত পঞ্চজন উপকীচককে সংহার করিলেন।
পরে ভীমসেন বাষ্পাকুললোচনা দীনা দ্রৌপদীকে বন্ধনমুক্ত করিয়া আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন, “প্রিয়ে! যাহারা নিরপরাধে তোমাকে ক্লেশ প্ৰদান করিবে, আমি অবশ্যই এইরূপে তাহাদিগকে সংহার করিব। এক্ষণে তোমার আর কোন শঙ্কা নাই; তুমি পরমসুখে নগরাভিমুখে গমন কর; আমি অন্য পথ অবলম্বনপূর্ব্বক বিরাটরাজের মহানসে প্রবেশ করিব।”
হে মহারাজ! এইরূপে একশত ও পঞ্চ কীচক বিনষ্ট হইয়া ছিন্ন-পাদপের ন্যায় ধরাশয্যায় শয়ন করিয়া রহিল। একশত পঞ্চ জন উপকীচক ও সেনাপতি কীচক এই ষড়ধিক শত মহাবীর ভীমসেনের হস্তে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। তত্ৰত্য সমুদয় নর ও নারীগণ এই আশ্চৰ্য্য ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইয়া রহিল; কাহারও আর বাক্যস্ফুর্ত্তি হইল না।