২৩৯তম অধ্যায়
কৰ্ম্মসাপেক্ষ মোক্ষধর্ম্মব্যাখ্যা
ভীষ্ম কহিলেন, “মহাত্মা শুকদেব মহর্ষি ব্যাসের এইরূপ বাক্য শ্রবণপূৰ্ব্বক তাঁহার সবিশেষ প্রশংসা করিয়া মোক্ষধর্ম্মানুগত প্রশ্ন জিজ্ঞাসায় সমুৎসুক হইয়া কহিলেন, ‘তাত! প্রজ্ঞাবান যাজ্ঞিক ও অসূয়াশূন্য শ্রোত্রিয় প্রত্যক্ষ, অনুমান ও উপদেশের অবিষয়ীভূত ব্রহ্মাকে কি প্রকারে প্রাপ্ত হইয়া থাকেন? তপ, ব্রহ্মচর্য্য, সৰ্ব্বত্যাগী, মেধা, আত্মানাত্মবিচার [আত্মা ও অনাত্মার বিচার] ও অষ্টাঙ্গ[যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা, সমাধি]যোগ, ইহার কোন উপায়দ্বারা তিনি উপলব্ধ হইয়া থাকেন? কিরূপ উপায় অবলম্বন করিলে, মন ও ইন্দ্রিয়ের একাগ্রতা স্থাপন করা যাইতে পারে? আপনি এই সমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।
“ব্যাস কহিলেন, ‘বৎস! বিদ্যালাভ, তপানুষ্ঠান, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ ও সৰ্ব্বত্যাগ ব্যতিরেকে কদাচ সিদ্ধিলাভ করা যায় না। জগদীশ্বর পৃথিব্যাদি মহাভূতসকলের সৃষ্টি করিয়া তৎসমুদয় জীবগণের শরীরে সন্নিবেশিত করিয়াছেন। জীবগণ সেই মহাভূতসকলকে আত্মা হইতে অভিন্ন জ্ঞান করিয়া থাকে। প্রাণীগণের ভূমি হইতে দেহ, জল হইতে স্নেহ ও জ্যোতি হইতে চক্ষু লাভ হইয়াছে; বায়ু প্রাণ ও অপানকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে এবং আকাশ শ্ৰোত্রাদিতে অবস্থান করিতেছে। জীবগণের চরণে বিষ্ণু, হস্তে ইন্দ্র, উদরে অগ্নি, কর্ণে দিক্ ও জিহ্বায় সরস্বতী ভোগবাসনায় অবস্থান করিতেছেন। কর্ণ, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা ও নাসিকা ইহারা জ্ঞানেন্দ্রিয় ও শব্দাদি জ্ঞানের দ্বারস্বরূপ। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ ইহারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, ইহাদিগকে ইন্দ্রিয় হইতে পৃথক্রূপে অবগত হইতে হইবে। সারথি যেমন বশীভূত অশ্বসকলকে প্রেরণ করে, সেইরূপ মন ইন্দ্রিয়গণকে স্ব স্ব বিষয়ে নিয়োগ করিতেছে। জীব আবার হৃদয়ে অবস্থান করিয়া সেই মনকে সতত নিযুক্ত করিয়া থাকে। মন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের এবং জীব মনের সৃষ্টিসংহারের কারণরূপে অভিহিত হয়। ইন্দ্রিয়, রূপরসাদি ইন্দ্রিয়ার্থ, শীতোষ্ণাদি ধৰ্ম্ম, চেতনা, মন, প্রাণ, অপান ও জীব নিরন্তর মনুষ্যের দেহমধ্যে অবস্থান করিতেছে।
পরমাত্মার পরিচয়—অনুভবের উপায়
‘সত্ত্বাদি গুণসমুদয়ও বুদ্ধ্যাদি জীবের আশ্রয় নহে; পরমাত্মাই জীবের একমাত্র আশ্রয়। পরমাত্মা জীবের স্রষ্টা, গুণসমুদয় জীবের সৃষ্টিবিধানে কদাচ সমর্থ নহে। মনীষী ব্রাহ্মণ শব্দাদি পঞ্চ বিষয়, দশ ইন্দ্রিয় ও মন এই ষোড়শ গুণপরিবৃত জীবাত্মাকে মনদ্বারা বুদ্ধিমধ্যে নিরীক্ষণ করিয়া থাকেন। পরমাত্মা চক্ষুকর্ণাদি ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য নহেন; কেবল দীপস্বরূপ বিশুদ্ধ মনদ্বারাই তিনি প্রকাশিত হইয়া থাকেন। পরমাত্মা অব্যয়, অশরীরী, ইন্দ্রিয়বিরহিত এবং শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধশূন্য। যোগিগণ তাঁহাকে দেহমধ্যে নিরীক্ষণ করিবেন। জড়দেহে অব্যক্তভাবে অবস্থিত পরমাত্মাকে যিনি প্রত্যক্ষ করিতে পারেন, তিনি দেহান্তে ব্রহ্মভাবপ্রাপ্ত হয়েন। পণ্ডিতেরা বিদ্বান্ সৎকুলসমুৎপন্ন ব্রাহ্মণ, গো, হস্তী, কুক্কুর ও চণ্ডালকে সমভাবে দর্শন করিয়া থাকেন। সেই অদ্বিতীয় পরমাত্মা স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমস্ত ভূতে ওতপ্রোতভাবে [অন্তৰ্য্যাপ্তভাবে—অচ্ছেদ্যসম্বন্ধে সম্বন্ধভাবে] অবস্থান করিতেছেন। যখন জীব আপনাতে সমস্ত ভূত ও ভূতসমুদয়ে আপনাকে অভিন্নভাবে দর্শন করেন, তখনই তাঁহার ব্রহ্মপ্রাপ্তি হইয়া থাকে। যিনি আত্মাকে আত্মদেহ ও পরদেহে তুল্যরূপ জ্ঞান করেন, তিনিই মুক্তিলাভে সমর্থ হয়েন। যিনি ব্রহ্মভাবলাভার্থী হইয়া সকল ভূতকেই আত্মতুল্য বিবেচনা করেন এবং যিনি সকল ভূতের হিতাভিলাষী, দেবতারাও সেই অলৌকিক পথগামী মহাত্মার গমনপথ অবধারণ করিতে অসমর্থ হইয়া বিমুগ্ধ হইয়া থাকেন। যেমন আকাশে পক্ষীর ও জলমধ্যে মৎস্যের গমনচিহ্ন কিছুমাত্র প্রত্যক্ষ হয় না, সেইরূপ জ্ঞানীদিগের গতি অন্যের
অনুভূত হইবার নহে
। কাল সকল ভূতকেই বিনষ্ট করিতেছে; কিন্তু যাঁহার প্রভাবে সেই কাল বিনষ্ট হইয়া থাকে, তাঁহাকে কেহই পরিজ্ঞাত হইতে পারে না। সেই পরমস্বরূপ পরমাত্মা ঊৰ্দ্ধ, অধ, মধ্য বা তির্য্যক স্থানে অবলোকিত হয়েন না, এই সমুদয় লোকই তাঁহার অন্তরস্থ; তাঁহার বহির্ভাগে কিছুই নাই। যদি কেহ মন ও কার্ম্মুকনির্ম্মুক্ত শরের ন্যায় অপ্রতিহতবেগে গমন করে, তাহা হইলেও সেই সকলের কারণ ঈশ্বরের অন্ত প্রাপ্ত হইতে পারে না।
‘তিনি সূক্ষ্ম অথচ স্থূল হইতেও স্থূল; তাঁহার ইয়ত্তা করা কাহারও আয়ত্ত নহে। সৰ্ব্বত্রই তাঁহার হস্তপদ, সৰ্ব্বত্রই তাঁহার মুখ, চক্ষু ও মস্তক এবং সর্ব্বত্রই তাঁহার কর্ণ বিকীর্ণ রহিয়াছে। তিনি সমস্ত লোক আবৃত করিয়া অবস্থান করিতেছেন। তিনি সৰ্ব্বভূতের অন্তরে স্থিরভাবে অবস্থান করিলেও কেহ তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয় না। পরমাত্মা অক্ষর ও ক্ষর এই দুই প্রকারে নির্দ্দিষ্ট হয়েন। তন্মধ্যে অবিনাশী চৈতন্য অক্ষর এবং স্থাবরজঙ্গমাত্মক জড়দেহ ক্ষর বলিয়া অভিহিত হয়। স্থাবর জঙ্গমাত্মক সমস্ত পদার্থের অধিপতি, নিশ্চল, নিরুপাধিক, পরমাত্মা নবদ্বারযুক্ত পুরমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া হংস [জীবাত্মা] রূপে নির্দ্দিষ্ট হয়েন। আর পণ্ডিতেরা মহদাদি চতুর্ব্বিংশতি পদার্থসঞ্চিত [তত্ত্বসমষ্টি], ক্ষয়, সুখদুঃখ, বিপর্য্যয় ও বিবিধ কল্পনাসম্পন্ন শরীরমধ্যে জন্মরহিত জীবাত্মাকে হংস বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে অভিন্ন জ্ঞান করেন। তিনি সেই পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হয়েন, তিনি উপাধি ও জন্ম পরিত্যাগ করিয়া থাকেন।’ ”