২৩৭. প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি ধৰ্ম্মের অধিকারিভেদ

২৩৭তম অধ্যায়

প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি ধৰ্ম্মের অধিকারিভেদ

“ব্যাস কহিলেন, ‘বৎস! বিদ্বান ব্যক্তিরা এই সংসারসমুদ্রে বারংবার উন্মগ্ন ও নিমগ্ন হইয়া পরিশেষে আপনার মুক্তি লাভের হেতুভূত জ্ঞানরূপ ভেলাকে অবলম্বন করেন।’

“শুকদেব কহিলেন, ‘তাত! যে জ্ঞানপ্রভাবে জন্মমৃত্যুকে অতিক্রম করা যায়, উহা কি মোক্ষসাধিকা বুদ্ধি, না প্রবৃত্তিলক্ষণ ধৰ্ম্ম, অথবা বিষয়ব্যাবৃত্তি [বিষয়পরাঙ্মুখতা]?’

“বেদব্যাস কহিলেন, ‘বৎস! যাহারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করিয়া কেবল স্বভাবকে কারণ বলিয়া নির্দ্দেশপূৰ্ব্বক স্বীয় জ্ঞানপ্রভাবে মুমুক্ষু শিষ্যগণকে উপদেশ প্রদান করে, তাহারা মূঢ়। স্বভাব কারণ বলিয়া যাহাদিগের দৃঢ়সংস্কার হইয়াছে, ঋষি বা অন্যান্য ব্যক্তিদিগের উপদেশবাক্য- শ্রবণ করিলেও তাহাদিগের কিছুমাত্র তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয় না। আর যাহারা স্বভাবই কারণ, এই মত অবলম্বন করিয়া নিশ্চিন্ত হয়, তাহারাও কখন আপনার হিতানুষ্ঠানে সমর্থ হইতে পারে না। অতএব মূঢ়ব্যক্তিদিগের মনোমধ্যে স্বভাবই সমুদয়ের কারণ বলিয়া যে বুদ্ধি উপস্থিত হয়, উহা কেবল তাহাদের বিনাশের নিমিত্তই হইয়া থাকে। এক্ষণে স্বভাব যে জগতের কারণ নহে, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যদি স্বভাবই সমুদয় পদার্থের কারণ হইত, তাহা হইলে কৃষাদি কাৰ্য্যের নিমিত্ত লোকের আর যত্ন করিবার আবশ্যক থাকিত না; সকল বস্তুই স্বয়ংসম্ভূত হইতে পারিত। কিন্তু দেখ, বিজ্ঞ ব্যক্তিরা কৃষাদি কাৰ্য্যসমুৎপন্ন শস্যসংগ্রহ এবং যান, আসন, আবাসগৃহ, ক্রীড়াগৃহ ও রোগের ঔষধসমুদয় প্রস্তুত করিতেছেন। প্রজ্ঞাবলে অর্থসিদ্ধি ও শ্ৰেয়োলাভ হয়। নরপতিরা প্রজ্ঞাবলেই রাজ্য ভোগ করিয়া থাকেন। জ্ঞানবলে ভূতসমুদয়ের স্থূল-সূক্ষ্ম ভেদ অবগত হইতে পারা যায়। বিদ্যাশক্তিপ্রভাবে সমুদয় পদার্থের সৃষ্টি হইয়াছে; আবার বিদ্যাতেই সমুদয় লয় প্রাপ্ত হয়।

‘জীব সমুদয় চারি প্রকার—জরায়ুজ, অণ্ডজ, উদ্ভিজ্জ ও স্বেদজ। জঙ্গম পদার্থসমুদয়ের চেষ্টা আছে বলিয়া উহারা স্থাবর পদার্থ হইতে শ্রেষ্ঠ। জঙ্গমের মধ্যে দ্বিপাদ ও বহুপদসম্পন্ন অনেক জীব বিদ্যমান রহিয়াছে, তন্মধ্যে দ্বিপাদ প্রাণীগণ বহুপাদ জন্তু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। দ্বিপাদ আবার দুই প্রকার—মনুষ্য ও পিশাচাদি। তন্মধ্যে পার্থিব মনুষ্যগণ অন্নাদি ভোগসুখে নিরত থাকে বলিয়া উহারা পিশাচাদি অপেক্ষা প্রধান। পার্থিব মনুষ্যগণ আবার দুই প্রকার—উত্তম ও মধ্যম। উত্তমেরা বিশুদ্ধজ্ঞানলাভ নিবন্ধন মধ্যমগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। মধ্যমেরা আবার জাতিধৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে বলিয়া নিকৃষ্ট অপেক্ষা প্রধান। মধ্যম দুই প্রকার-ধৰ্ম্মজ্ঞ ও অধৰ্ম্মজ্ঞ। ধৰ্ম্মজ্ঞ ব্যক্তিরা কাৰ্য্য ও অকাৰ্য্যের অবধারণে সমর্থ বলিয়া উহারা অধৰ্ম্মজ্ঞ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ধৰ্ম্মজ্ঞ ব্যক্তিরাও আবার বৈদিক ও অবৈদিক এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত! তন্মধ্যে বেদের প্রতিষ্ঠানিবন্ধন বেদজ্ঞ ব্যক্তিরাই প্রধান বলিয়া পরিগণিত হয়েন। বেদজ্ঞ ব্যক্তিদিগের মধ্যেও বেদবক্তা ও বেদবক্তৃতাবিহীন এই দুই শ্রেণী নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে; তন্মধ্যে বেদবাদী, ব্যক্তিরা বেদ এবং বেদনির্দ্দিষ্ট ক্রিয়াকলাপ ও যজ্ঞবিধিসমুদয় বিশেষ বিদিত হইয়া ঐ সমুদয়ের প্রচার করিয়া দেন বলিয়া অপেক্ষাকৃত প্রধানরূপে কীর্ত্তিত হইয়া থাকেন। বেদবক্তাও আবার আত্মতত্ত্বজ্ঞ ও আত্মজ্ঞানবিহীন এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। তন্মধ্যে আত্মতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিরা জন্মমৃত্যুর কারণনির্দ্ধারণে সমর্থ বলিয়া আত্মজ্ঞানবিহীন অপেক্ষা প্রধান বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হয়েন। যিনি প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তিরূপ ধৰ্ম্মদ্বয়কে অবগত হইতে সমর্থ হয়েন, তিনিই

যথার্থ ধর্ম্মজ্ঞ, সৰ্ব্ববেত্তা, সৰ্ব্বত্যাগী, সত্যপরায়ণ, পবিত্র ও প্রভু। দেবতারা বেদজ্ঞ ও ব্রহ্মপরায়ণ ব্যক্তিদিগকেই ব্রাহ্মণ বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। যে ব্রাহ্মণেরা বাহ্য ও অন্তঃস্থিত আত্মাকে অবলম্বন করিতে সমর্থ হয়েন, তাঁহারাই দেবতা। ঐ সকল ব্যক্তিতেই এই বিশ্বসংসার প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। উহাদিগের মাহাত্মের সদৃশ উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই। উহারা জন্ম, মৃত্যু ও কৰ্ম্মসমুদয় অতিক্রমপূৰ্ব্বক চতুর্ব্বিধ জীবের ঈশ্বর হইয়া অবস্থান করিয়া থাকেন।”