২৩৭তম অধ্যায়
দুৰ্য্যোধনাদির দ্বৈতবন-সন্নিহিত ঘোষপল্লীযাত্রার মন্ত্রণা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নৃপবর! রাজা দুৰ্য্যোধন কর্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; কিন্তু পুনরায় দীনের ন্যায় কহিতে লাগিলেন, “হে অঙ্গরাজ! তুমি যে-সকল কথা কহিলে, তৎসমুদয় আমারও মনে জাগরকে আছে, কিন্তু পিতার নিকট হইতে পাণ্ডবগণের সন্নিধানে গমন করিবার অনুমতি প্রাপ্ত হই নাই। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তাহাদের নিমিত্ত পরিদেবন ও তাহাদিগকে সমধিক তপোবলসম্পন্ন বিবেচনা করিয়া থাকেন, অথবা তিনি আমাদিগের অভিপ্ৰায় বুঝিতে পারিয়াও ভাবী অনিষ্টঘটনার সম্ভাবনায় আমাদিগকে তথায় গমন করিতে অনুমতি করেন না। আর পাণ্ডবগণের উৎসাদন ব্যতীত আমাদিগের দ্বৈতবনে গমন করিবারও অন্য কোন প্রয়োজন নাই।
“হে কৰ্ণ মহামতি বিদুর দ্যূতক্রীড়ার সময় সমুপস্থিত হইলে তোমাকে, আমাকে ও শকুনিকে যাহা যাহা কহিয়াছিলেন, তৎসমুদয় তোমার বিদিত আছে। আমিও সেই সকল কথা এবং অন্যান্য পরিদেবনবাক্য চিন্তা করিয়া দ্বৈতবনে গমন করিব কি না, ইহার কিছুই স্থির করিতে সমর্থ হইতেছি না। যাহা হউক, এক্ষণে কৃষ্ণাসমবেত ভীম ও অর্জ্জুনকে অরণ্যানীমধ্যে ক্লেশভোগ করিতে নিরীক্ষণ করিব মনে করাতে আমার চিত্ত নিতান্ত প্ৰফুল্ল হইতেছে। ফলতঃ পাণ্ডুনন্দনগণকে বল্কলাজিনধারিদর্শনে আমার যেরূপ সুখী হইবার সম্ভাবনা, বোধ করি, সমুদয় সসাগরা ধরার আধিপত্য লাভ করিয়াও তাদৃশ আনন্দ হয় নাই।
“হে কর্ণ। আমি অরণ্যমধ্যে দ্রৌপদীকে যে কাষায়বসনধারিণী অবলোকন করিব, ইহার পর আর সুখের বিষয় কি হইতে পারে? যদি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ও ভীমসেন আমাকে অসামান্য সম্পত্তিসম্পন্ন অবলোকন করে, তাহা হইলে আমার জীবন প্রফুল্ল হইবে ও আহ্লাদের আর পরিসীমা থাকিবে না। এখন কি করি? কি উপায়ে দ্বৈতবনে গমন করিব? কিরূপেই বা মহারাজের অনুমতি প্রাপ্ত হইব? তুমি শকুনি ও দুঃশাসনের সহিত পরামর্শ করিয়া তথায় যাইবার কোন উপায় স্থির কর। আমি তথায় গমন করিব কি না, ইহা অদ্যই স্থির করিয়া কল্য মহারাজের সমীপে গমন করিব; তোমরা যে উপায় স্থির করিবে, আমি এবং ভীষ্ম তথায় উপবিষ্ট থাকিলে পর তুমি শকুনি-সমভিব্যাহারে সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া তাহা অবশ্যই প্রকাশ করিবে। তৎপরে আমি মহারাজ ও পিতামহ ভীষ্মের বাক্যশ্রবণানন্তর পিতামহকেই অনুনয় করিয়া গমনে উদ্যত হইব।”
তাঁহারা দুৰ্য্যোধনের বাক্যে সম্মত হইয়া স্ব স্ব নিকেতনে গমন করিলেন। রজনী প্রভাত হইবামাত্ৰ কৰ্ণ দুৰ্য্যোধনের সমীপে আগমনপূর্ব্বক সহাস্যবদনে কহিলেন, “মহারাজ! উপায় স্থির হইয়াছে, শ্রবণ করা। দ্বৈতীবনে যে-সমস্ত আভীরপল্লী আছে, তৎসমুদয়ের তত্ত্বাবধান করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য ; অতএব আইস, আমরা ঘোষযাত্ৰাচ্ছলে দ্বৈতবনে গমন করি। বল্লবপল্লীতে সতত গমন করা নিতান্ত আবশ্যক বোধ করিয়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অবশ্যই গমনে অনুজ্ঞা প্রদান করিবেন।”
তাঁহারা দুইজনে এইরূপে ঘোষযাত্ৰাবিষয়ক কথোপকথন করিতেছেন, এমত সময় গান্ধাররাজ শকুনি তথায় আগমনপূর্ব্বক সহাস্যমুখে কহিলেন, “হে রাজন! আমি দ্বৈতবনে হমন করিবার এক অত্যুৎকৃষ্ট উপায় স্থির করিয়াছি; মহারাজের সম্মুখে উহা কহিবামাত্র তিনি তৎক্ষণাৎ গমনে অনুমতি প্ৰদান করিবেন। দ্বৈতবনে যে-সমুদয় আভীরপল্লী আছে, তৎসমুদয়ের তত্ত্বাবধারণ করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। অতএব আইস, আমরা এক্ষণে ঘোষযাত্ৰাচ্ছলে দ্বৈতবনে গমন করি।”
শকুনির বাক্য শ্রবণমাত্র তাঁহারা সকলেই পরমহ্লাদে হাস্য করিতে করিতে পরস্পরের করগ্রহণ করিলেন এবং ঐ উপায়ই স্থির করিয়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন।