২৩৬তম অধ্যায়
জ্ঞানপথে মুক্তির উপায়
“ব্যাস কহিলেন, ‘মুক্তি যদি প্রীতিকর হয়, তাহা হইলে জ্ঞান আশ্রয় করা অবশ্য কর্ত্তব্য। সমুদ্রের উত্তঙ্গ [অতি উচ্চ] তরঙ্গে উন্মগ্ন [উর্দ্ধদিকে উত্থিত, নিম্নদিকে নিমজ্জিত-ঢেউয়ের বেগ একবার উপরে তোলে; আবার সঙ্গে সঙ্গেই তলিয়ে দেয়] ও নিমগ্ন ব্যক্তি যেমন ভেলা অবলম্বন করিয়া পার হইয়া থাকে, সেইরূপ মনুষ্য জ্ঞান আশ্রয় করিলে অনায়াসে এই সংসারসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারে। যাঁহারা জ্ঞানবান, তাঁহারা জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞদিগকে মোলাভে অধিকারী করিতে সমর্থ হয়েন; কিন্তু, যাহারা কিছু মাত্র জ্ঞানোপার্জ্জন করে নাই, তাহারা আপনাকে বা অন্যকে কদাচ বিমুক্ত করিতে পারে না। যিনি ধ্যানে মনোনিবেশ করিবেন, পরিচ্ছন্ন প্রদেশে অবস্থান, যোগসাধক কর্ম্মের অনুষ্ঠান, যোগে অনুরাগপ্রদর্শন, শরীরযাত্রানির্ব্বাহক [দেহমাত্র রক্ষার উপযোগী] ফলমূল ভক্ষণ, আসনাদি যোগ, বৈরাগ্য অবলম্বন, বেদবাক্যে সিদ্ধান্তবুদ্ধি, ইন্দ্রিয়সংযম, আহারের নিয়ম, স্বাভাবিক বিষয়প্রবৃত্তি-সঙ্কোচ, মনঃসংযম ও দুঃখদোষাদি দর্শন করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। যিনি উৎকৃষ্ট জ্ঞানলাভের প্রত্যাশা করেন, বুদ্ধিবল আশ্রয় করিয়া বাক্য ও মনঃসংযম করা তাঁহার আবশ্যক। আর যিনি শান্তিলাভের অভিলাষ করেন, জ্ঞানবলে আত্মসংযম করা তাঁহার শ্রেয়স্কর। ব্রাহ্মণ বেদজ্ঞ বা নিতান্ত নিষ্ঠুর ও বেদানভিজ্ঞ, পাপস্বভাব বা ধার্ম্মিক ও যাজ্ঞিক অথবা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বা নিরন্তর ক্লেশে নিপতিত যে কোনরূপ হউক না কেন, যদি তিনি বাগাদিসংযম করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই জরামৃত্যুরূপ দুর্গ অনায়াসে অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়েন। যোগযুক্ত হইয়া একমাত্র পরব্রহ্মকে জ্ঞাত হওয়া দূরে থাকুক, জ্ঞাত হইতে অভিলাষী হইলেও স্বকৰ্ম্মত্যাগজনিত দোষে আর লিপ্ত হইতে হয় না।
‘হে বৎস! অতঃপর ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায় নির্দ্দেশ করিতেছি, শ্রবণ কর। মনুষ্যের দেহ রথ স্বরূপ। যজ্ঞাদিধর্ম্ম উহার সারথির উপবেশনস্থান; অকার্য্যনিবৃত্তি উহার বরূথ [রথমধ্য গুপ্তস্থান]; বৈরাগ্য ও আসনাদিযোগ উহার কুবরদ্বয় [ধুরার আধার]; আপান উহার অক্ষ [চক্র]; প্রাণ উহার যুগকাষ্ঠ [জোয়াল]; প্রজ্ঞা উহার সার [কার্য্যকারিতা]; জীব উহার বন্ধন; সাবধানতা উহার ফলকদ্বয়ের সংশ্লেষ [ফলার সংযোগস্থল]; চরিত্র উহার নেমি [চক্রের পরিধি]; দর্শন, স্পর্শন, ঘ্রাণ ও শ্রবণ উহার চারি অশ্ব; প্রজ্ঞা উহার রথীর উপবেশনস্থান; সমস্ত সিদ্ধান্তশাস্ত্র উহার প্রতোদ [চাবুক]; জ্ঞান উহার সারথি। আত্মা উহার অধিষ্ঠাতা; শ্রদ্ধা ও ইন্দ্রিয়নিগ্রহ উহার পুরঃসর [অগ্রভাগ]; ত্যাগ উহার পরম উপকারী চেট [দাসত্য] এবং ধ্যান উহার প্রাপ্য অর্থ। ঐ রথ মূমুক্ষু কর্ত্তৃক যোজিত হইলে বিশুদ্ধ মার্গ অবলম্বনপূর্ব্বক ব্রহ্মলোকে গমন করিয়া বিরাজমান হয়।
যোগ অবলম্বনে মুক্তিপথে প্রবেশ
‘এক্ষণে যিনি অতি ত্বরায় অক্ষয় ব্রহ্মলাভের মানস করিয়া ঐ রথ যোজন করিতে অভিলাষী হয়েন, তাঁহার নিমিত্ত এক সহজ উপায় নির্দ্দেশ করিয়া দিতেছি, শ্রবণ কর। এক বিষয়ে চিত্তসন্নিবেশকে ধারণা পলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকে। ধারণার বিষয় সাতটি—পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, সলিল, তেজ, অহঙ্কার ও বুদ্ধি। সংযমী ব্যক্তি ক্রমশঃ এই সাত প্রকার ধারণা করিয়া উহাদের ফল ক্রমশঃ প্রাপ্ত হইবেন। এই সপ্তবিধ ধারণা ব্যতীত দূরস্থ চন্দ্র, সূৰ্য্য এবং সন্নিকৃষ্ট নাসা প্রভৃতি পদার্থে বিবিধ ধারণার বিষয় শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট আছে। তদ্ভিন্ন নিয়ম অবলম্বনপূর্ব্বক অব্যক্ত ধারণার ফললাভ করাও সংযমীদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। এক্ষণে শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট প্রণালী অনুসারে যোগে প্রবৃত্ত ব্যক্তি স্বীয় আত্মাতে যেরূপে যোগসিদ্ধি অনুভব করিয়া থাকেন, আমি তাহাও কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
‘স্থূলদেহের সহিত আত্মার অভেদবুদ্ধিবিমুক্ত [ভেদবুদ্ধিবিহীন] যোগী সৰ্ব্বাগ্রে হৃদয়াকাশে আকাশ-সমাশ্রিত সূক্ষ্ম নীহারের ন্যায় পদার্থ দর্শন করিয়া থাকেন। অনন্তর সেই ধূমরূপ তিরোহিত হইলে তাঁহার হৃদয়াকাশে জলরূপ দর্শন হয়; জলাকার অন্তর্দ্ধান করিলে বহ্নিরূপ দৃষ্ট হইয়া থাকে; বহ্নিরূপ তিরোহিত হইলে সৰ্ব্বসংহারক বায়ুরূপ প্রকাশিত হয় এবং সেই বায়ু সূক্ষ্ম হইলে উহার রূপ ঊর্ণাতন্তুর ন্যায় নিরীক্ষিত হইয়া থাকে। তৎপরে উহা শুদ্ধগতি প্রাপ্ত হইয়া বিরূপ [রূপহীন] আকাশের ন্যায় প্রতীয়মান হয়।
যোগলব্ধ বিভূতিতে জীবাত্মা-পরমাত্মার জ্ঞান
‘যোগীদিগের এই সমস্ত রূপ অনুভূত হইলে যে প্রকার ফল উৎপন্ন হইয়া থাকে, তাহাও শ্রবণ কর। যে যোগী পার্থিব ঐশ্বর্য্যে সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন, তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার ন্যায় অক্ষুব্ধ হইয়া স্বীয় কলেবর হইতে প্রজা সৃষ্টি করিতে সমর্থ হয়েন। যাঁহার বায়ু সিদ্ধ হইয়াছে, তিনি কর, চরণ বা অঙ্গুষ্ঠদ্বারা পৃথিবীকে কম্পিত করিতে পারেন। আকাশসিদ্ধ ব্যক্তি আকাশের সারূপ্য লাভ করিয়া আকাশে প্রকাশিত হইয়া থাকেন এবং স্বীয় দেহকে অন্তর্হিত করিতে সমর্থ হয়েন। সলিলসিদ্ধ ব্যক্তি স্বেচ্ছানুসারে কূপতড়াগাদি পান করিতে পারেন। অগ্নিসিদ্ধ ব্যক্তির রূপ তেজঃপ্রভাবে নিরীক্ষিত হয় না; কিন্তু তিনি অগ্নির শমতাবিধান করিলেই তাঁহার আকার প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে। যোগীর অহঙ্কার পরাজিত হইলে পঞ্চভূত অনায়াসে বশবর্তী হয়। পঞ্চভূত ও অহঙ্কারের স্বরূপবুদ্ধি পরাজিত হইলে সংশয়বিপর্য্যয়শূন্য জ্ঞান প্রাদুর্ভূত এবং বুদ্ধি প্রভৃতি ব্যক্ত ও অব্যক্ত ব্ৰহ্মভাব পরিজ্ঞাত হইয়া থাকে। বুদ্ধি প্রভৃতি পদার্থসমুদয় কার্য্যে প্রবৃত্ত হয় বলিয়া উহাদিগকে ব্যক্ত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়।
‘এক্ষণে অব্যক্ত বিষয় জ্ঞাত হইবার পূৰ্ব্বে সাজ্জ যেরূপ ব্যক্ত বিষয়ের নির্ণয় করিয়া গিয়াছে, তাহা শ্রবণ কর পরিশেষে অব্যক্ত বিষয়ও সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিব। সাঙ্খ্য ও যোগশাস্ত্রে পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব তুল্যরূপে নির্ণীত আছে, এক্ষণে উহা বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। জন্ম, বৃদ্ধি, জরা ও মৃত্যু এই চারি লক্ষণসম্পন্ন মহত্তত্ত্বাদিজনিত দেহের নাম ব্যক্ত। আর জম্মাদিলক্ষণচতুষ্টয়বর্জ্জিত প্রকৃতিকে অব্যক্ত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। বেদ ও অন্যান্য সিদ্ধান্তশাস্ত্রে জীবাত্মা ও পরমাত্মা এই দুই প্রকার আত্মা নিরূপিত হইয়াছে। তন্মধ্যে জীবাত্মা মহদাদি তত্ত্বরূপ উপাধিযুক্ত, চতুৰ্ব্বৰ্গফলাকাঙ্ক্ষী ও পরমাত্মা হইতে উদ্ভূত। শাস্ত্র ইহাকেও ব্যক্ত বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়ই চেতনস্বরূপ হইয়াও জড়দেহাদির সহিত অভিন্নভাবে বর্ত্তমান থাকেন। এই আমি তোমার নিকট জড় ও চৈতন্যের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। বিষয়ানুরাগী ব্যক্তিদিগের নিমিত্তই বেদে উভয়বিধ আত্মার বিষয় নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। তত্ত্বজ্ঞানীরা একমাত্র পরমাত্মাকেই দর্শন করিয়া থাকেন।
যোগপথে ব্ৰহ্মপ্রাপ্তি
‘উপনিষদ্বেত্তা জ্ঞানীরা বিষয় হইতে মনকে নিবৃত্ত করা অবশ্য কৰ্ত্তব্য বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন। যিনি মমতা ও অহঙ্কারপরিশূন্য, সুখদুঃখাদিবর্জ্জিত ও নিঃসংশয়; যাঁহার শরীরে ক্রোধ বা দ্বেষের লেশমাত্র নাই; যিনি কদাচ মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করেন না, তিরস্কৃত বা প্রহৃত হইয়াও যিনি মিত্রভাব প্রদর্শন করেন; যিনি কদাচ অন্যের অশুভ চিন্তা করেন না, যিনি কায়মনোবাক্যে পরপীড়াপ্রদানে পরাঙ্মুখ থাকেন এবং যিনি সৰ্ব্বভূতের প্রতি সমদর্শী, তিনিই ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইতে পারেন। যিনি বিষয়লাভে অভিলাষী না হইয়া অযত্নসুলভ বস্তু প্রতিগ্রহপূৰ্ব্বক জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন; যিনি লোভপরাঙ্মুখ, দুঃখশূন্য, ইন্দ্রিয়নিগ্রহশীল, যজ্ঞাদিকার্য্যবিহীন; যিনি কদাচ অন্যকে অবজ্ঞা বা অশ্রদ্ধা করেন না; যিনি সত্যসঙ্কল্প; যিনি সকলের প্রতি সমভাব স্থাপন করেন; লোষ্ট্র ও কাঞ্চনে যাঁহার তুল্যজ্ঞান; প্রিয় বা অপ্রিয় উপস্থিত হইলে যিনি হৃষ্ট বা অসন্তুষ্ট হয়েন না; নিন্দা ও স্তুতিবাদকে সমান জ্ঞান করিয়া থাকেন এবং যিনি স্পৃহাশূন্য, ব্রহ্মচর্য্যপরায়ণ ও অহিংসক, সেই যোগী মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হয়েন। এক্ষণে যে প্রকারে যোগ হইতে মুক্তিলাভ হয়, তাহা শ্রবণ কর। যিনি অণিমাদি যোগৈশ্বৰ্য্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন, তিনিই মুক্তিলাভে অধিকারী হয়েন। এই আমি তোমার নিকট তত্ত্ববোধিনী বুদ্ধি কীৰ্ত্তন করিলাম। এইরূপে যিনি কায়মনোবাক্যে যোগানুষ্ঠানে নিরত হইয়া সুখদুঃখাদিশূন্য হইতে পারেন, তিনি ব্রহ্মলাভে সমর্থ হয়েন, সন্দেহ নাই।”