২৩২. ব্ৰহ্মস্বরূপ নির্ণয়প্রসঙ্গে সৃষ্টিপ্রকরণ

২৩২তম অধ্যায়

ব্ৰহ্মস্বরূপ নির্ণয়প্রসঙ্গে সৃষ্টিপ্রকরণ

“ব্যাস বলিলেন, ‘তেজোময় ব্রহ্মই সকলের বীজস্বরূপ, তাহা হইতে এই সমুদয় বিশ্বসংসার সমুৎপন্ন হইয়াছে। তিনি সহায়বিহীন হইয়াও প্রথমতঃ জড়স্বরূপা মায়া ও চেতনাস্বরূপ পুরুষকে সৃষ্টি করিলেন। অনন্তর ঐ পুরুষ স্বয়ং উদ্যোগী হইয়া মায়াদ্বারা এই জগৎ সৃষ্টি করিতে লাগিলেন। প্রথমে মায়া হইতে মহত্তত্ত্ব, মহত্তত্ত্ব হইতে অহঙ্কার এবং অহঙ্কার হইতে আকাশাদি পঞ্চভূতাত্মক মনের সৃষ্টি হইল। দুরগমনশীল বহুধাগামী [বহুপ্রকার গতিশীল] এবং প্রার্থনা ও সংশয়াত্মক মন সৃষ্টিবিধানাভিলাষে ঈশ্বরকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া বিবিধ সৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিল। প্রথমতঃ ঐ মন হইতেই শব্দগুণ আকাশের উৎপত্তি হয়। তৎপরে আকাশ হইতে অতিপবিত্র বলবান্ স্পর্শগুণ বায়ুর, বায়ু হইতে দ্যুতিমান্‌ [তেজোযুক্ত] রূপগুণ অহ্নির, ঐ অগ্নি হইতে রসগুণ সলিলের এবং সলিল হইতে গন্ধগুণ পৃথিবীর সৃষ্টি হইল। এই পঞ্চমহাভূতমধ্যে যে ভূত যাহা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, সে তাহার গুণও লাভ করিয়াছে। আকাশ কোন মহাভূত হইতে সদ্ভূত হয় নাই; সুতরাং উহা আপনার গুণ ভিন্ন অন্য কাহারও গুণলাভে অধিকারী নহে। একমাত্র শব্দই উহার গুণ। বায়ুতে শব্দ ও স্পর্শ; অগ্নিতে শব্দ, স্পর্শ ও রূপ; সলিলে শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস এবং পৃথিবীতে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ বিদ্যমান রহিয়াছে। কোন কোন ব্যক্তি স্বীয় মূঢ়তানিবন্ধন জল ও বায়ুতে গন্ধের উপলব্ধি করিয়া ঐ গন্ধকে উভয়ের গুণ বলিয়াও কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে; কিন্তু উহা নিতান্ত যুক্তিবিরুদ্ধ; কারণ, গন্ধ কেবল পৃথিবীরই গুণ; উহা জল ও বায়ুতে মিলিত থাকে বলিয়া ঐ দুই পদার্থ গন্ধযুক্ত হয়; বস্তুতঃ গন্ধ উহাদিগের গুণ নহে।

‘যাহা হউক, ঐ মহত্তত্ত্বাদি সপ্ত পদার্থ পরস্পর ভিন্ন ভিন্ন রূপে অবস্থান করিয়া প্রজা সৃষ্টি করিতে সমর্থ হইল না। পরিশেষে তাহারা পরস্পর মিলিত হইয়া হস্তপদাদিবিশিষ্ট স্থূলশরীরে পরিণত হইল। ঐ স্থূলশরীরকে পুরী বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়; সুতরাং উহাতে যিনি বাস করিলেন, তাঁহার নাম পুরুষ। তৎপরে পঞ্চ কৰ্ম্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, শব্দ, রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও মন এই ষোড়শ পদার্থবিরচিত লিঙ্গশরীরে স্বীয় অদৃষ্টের সহিত স্থূলশরীরে প্রবিষ্ট হইল। পরে সৰ্ব্বভূতের আদিকর্ত্তা তপানুষ্ঠানের নিমিত্ত মায়া প্রভৃতিকে লইয়া সেই লিঙ্গশরীরে প্রবেশ করিলেন। লোকে উহাকে প্রজাপতি বলিয়া নির্দ্দেশ করে। উনি প্রথমে স্থাবরজঙ্গমের সৃষ্টি করিয়া পরে দেবতা, ঋষি, পিতৃলোক, নদী, সমুদ্র, পর্ব্বত, বৃক্ষ, নর, কিন্নর, রাক্ষস, পশু, পক্ষী, মৃগ ও সর্প এবং নিত্য অনিত্য সমুদয় পদার্থের সৃষ্টি করিলেন। প্রথম সৃষ্টিকালে যে-যে পদার্থ যে-যে গুণ অধিকার করিল, উহারা পুনরায় উৎপন্ন হইবার সময়েও সেই গুণের অধিকারী হইল। লোকে অদৃষ্টানুসারে হিংসা, অহিংসা, মৃদুতা, ক্রূরতা, ধৰ্ম্ম, অধৰ্ম্ম এবং সত্য ও মিথ্যা প্রভৃতি যাহা চিন্তা করে, সে পরজন্মে তাহা প্রাপ্ত হইয়া তদ্বিষয়ে রত হয়। জগদীশ্বরই আকাশাদি ভূত, রূপাদি ইন্দ্রিয়ার্থ এবং দ্রব্যসমুদয়ের আকৃতিসমুদয় নানারূপে সৃষ্টি করিয়া প্রাণীগণের সহিত তাহাদের ভোক্তৃভোজ্যভাব [ভোগকারী ও ভোগ্যভাব] নানাপ্রকারে নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। কেহ কেহ পুরুষকারকে, কেহ কেহ দৈবকে ও কেহ কেহ বা স্বভাবকেই কার্য্যের কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন এবং কেহ কেহ ঐ তিনের প্রত্যেকের প্রাধান্য স্বীকার না করিয়া উহারা একত্র হইয়া সমুদয় কাৰ্য্য সুসম্পন্ন করিতেছে বলিয়া থাকেন। কৰ্ম্মনিরত ব্যক্তিরাই এইরূপে কেহ পুরুষকারই কারণ, কেহ পুরুষকার কারণ নহে, কেহ কেহ দৈব ও পুরুষকার উভয়েই কারণ এবং কেহ বা এই উভয়ই কারণ নহে বলিয়া নানাপ্রকার বিবাদ করিয়া থাকেন; কিন্তু তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিরা পরমব্রহ্মাকেই সমুদয় কার্য্যের কারণ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন।

যুগধৰ্ম্ম—সৃষ্ট জীবের ধৰ্মকৰ্ম্মনিরূপণ

‘মনুষ্যেরা তপস্যাদ্বারাই মোক্ষলাভ করিতে পারেন। মন ও বাহ্য-ইন্দ্রিয়নিগ্রহই তপস্যার মূল। মনুষ্য বিশুদ্ধসত্ত্ব হইয়া তপোবলেই সমুদয় কামনা পূর্ণ করিতে পারে। তপস্যাদ্বারাই জগস্রষ্টা জগদীশ্বরকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। যে ব্যক্তি তপোবলে সেই পরব্রহ্ম লাভ করিতে পারেন, তিনিই সকলের প্রভু হইয়া থাকেন। মহর্ষিগণ তপোবলেই বেদ অধ্যয়ন করিয়া থাকেন। সৃষ্টির প্রথমে জগদীশ্বর আদ্যক্তশূন্যা বেদরূপা বাঙ্ময়ী [বাক্যময়ী—শব্দরূপা] বিদ্যার সৃষ্টি করিয়া তাহা হইতে ঋষিদিগের নাম, দেবগণের সৃষ্টি, প্রাণীগণের নানারূপ কার্য্যপ্রবৃত্তি ও মন্ত্ৰসমুদয়ের নাম কল্পনা করিয়াছেন। লোকসমুদয় সেই বেদশাস্ত্র অবলম্বন করিয়াই কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইতেছে। বেদশাস্ত্রে বেদাধ্যয়ন, গার্হস্থ্য, তপস্যা, নিত্যকর্ম্ম, নৈমিত্তিক কৰ্ম্ম, যজ্ঞ, পুষ্করিণী-প্রতিষ্ঠাদি, ধ্যান, ধারণা ও সমাধি এই দশবিধ জীবের মুক্তিলাভের উপায় যথাক্রমে কথিত হইয়াছে। বেদ ও বেদান্তে পণ্ডিতেরা যাঁহাকে পরবহ্ম বলিয়া নিরূপণ করিয়াছেন, তিনিই উক্ত দশবিধ উপায়দ্বারাই প্রত্যক্ষ হইয়া থাকেন। দেহাভিমানী জীবগণ কাৰ্য্যদ্বারা সুখদুঃখযুক্ত ভেদবুদ্ধি প্রাপ্ত হয়; কিন্তু তত্ত্বজ্ঞানী পুরুষ বলপূৰ্ব্বক [কৰ্ম্মতন্ত্রের স্বাধীন না হইয়া] মুক্তিলাভ করিতে পারেন।

‘বেদ ও বেদপ্রতিপাদ্য পরব্রহ্ম উভয়ই পরিজ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি বেদশাস্ত্র বিশেষরূপে অবগত হইতে পারেন, তিনিই অনায়াসে পরব্রহ্মলাভে সমর্থ হয়েন। ব্রাহ্মণের ব্রহ্মোপাসনা, ক্ষত্রিয়ের দেবগণের তৃপ্তিসাধনার্থ পশুহিংসা, বৈশ্যের দেবদ্বিজের তৃপ্তিসাধনোদ্দেশে শস্যোৎপাদন ও শূদ্রের তিন বর্ণের উপাসনাই যজ্ঞ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে। সত্যযুগে যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল না। ত্রেতাযুগেই যজ্ঞানুষ্ঠান করা বিধেয় বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে। দ্বাপরে যজ্ঞের নাশ হইতে আরম্ভ হইয়াছে। কলিতে আর যজ্ঞের সম্পর্কও থাকিবে না। সত্যযুগে মানবগণ অদ্বৈতনিষ্ঠ হইয়া ঋক্, সাম ও যজুর্ব্বেদোক্ত কাম্য যজ্ঞসমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কেবল যোগবল আশ্রয় করিয়াছিলেন। ত্রেতাযুগে যেসমস্ত পরাক্রান্ত ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহারাই স্থাবরজঙ্গম সমুদয় প্রাণীর শাসন করিয়া গিয়াছেন। তৎকালে সমুদয় লোক বেদাধ্যয়ন, যজ্ঞানুষ্ঠান ও ধর্ম্মশাস্ত্রের আলোচনায় অনুরক্ত ছিল। দ্বাপরযুগের লোকসমুদয়ের আয়ুর অল্পতাপ্রযুক্ত বেদাধ্যয়নাদি হীনদশা প্রাপ্ত হইয়াছে। কলিযুগে বেদসমুদয় কখন লক্ষিত ও কখন অলক্ষিত হইবে। মানবগণ কেবল অধৰ্মকর্ত্তৃক পীড়িত হইয়া যজ্ঞের সহিত উৎসন্ন হইয়া যায়। সত্যযুগে যেরূপ চতুষ্পদ ধর্ম্ম বিদ্যমান ছিল, এক্ষণে কোন কোন জিতচিত্ত তপানুষ্ঠাননিরত! বেদান্তশ্রবণশীল ব্রাহ্মণে সেই ধৰ্ম্ম লক্ষিত হইয়া থাকে। বেদজ্ঞ ব্যক্তি স্বধর্ম্মাচারী হইয়াও যুগধর্ম্ম নিবন্ধন কামনাপূৰ্ব্বক যথাশাস্ত্র যজ্ঞব্রত ও তীর্থস্নানাদির অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। যেমন বর্ষাকালে বৃষ্টিদ্বারা নূতন নূতন বিবিধ স্থাবরজঙ্গমের সৃষ্টি হয়, তদ্রূপ প্রতিযুগেই নূতন নূতন ধর্ম্মের সৃষ্টি হইয়া থাকে। যেমন শীতাদি ঋতু একবার বিগত হইয়া পুনরায় সমাগত হইলে তৎসমুদয়ে তাহাদের বিশেষ বিশেষ চিহ্নসকল আবির্ভূত হয়, তদ্রূপ প্রলয়াবসানে ব্রহ্মাদিতেও পূৰ্ব্ববৎ আধিপত্য উপস্থিত হইয়া থাকে। আমি পূৰ্বে তোমার নিকট যে প্রজাগণের সৃষ্টিসংহারকারক, জন্মনাশশূন্য বিবিধরূপী কালের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়াছি, প্রজাগণ সেই কালপ্রভাবেই উৎপন্ন ও লয়প্রাপ্ত হইতেছে। যেসমস্ত প্রাণী সুখদুঃখনিরত হইয়া স্বভাবানুসারে অবস্থান করে, কালই তাহাদের আশ্রয় ও পোষণকর্ত্তা। এই আমি তোমার নিকট সৃষ্টি, কাল, যজ্ঞাদি, বেদ, কৰ্ত্তা, কাৰ্য্য ও ক্রিয়াফলের বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম।