২৩১তম অধ্যায়
ব্ৰহ্মতত্ত্বব্যাখ্যা—ব্যাস-শুকসংবাদে কালনিরূপণ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! সৰ্ব্বজীবের আদি, অন্ত, ধ্যান, কাৰ্য্য, কাল ও যুগভেদ আয়ুর তারতম্য কি প্রকার এবং কি হইতেই বা তাহাদিগের সদ্গতি, অসদ্গতি, উৎপত্তি ও প্রলয় হইয়া থাকে, এই সমুদয় অবগত হইতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে। অতএব যদি আমার প্রতি আপনার অনুগ্রহ থাকে, তাহা হইলে তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন। মহর্ষি ভরদ্বাজের মুখে ভৃগুকথিত নীতিগর্ভ উৎকৃষ্ট বাক্যসমুদয় শ্রবণ করিয়া আমার বুদ্ধি অলৌকিক নিষ্ঠাসম্পন্ন ও যোগধর্ম্মের অনুগত হইয়াছে; এই নিমিত্ত আপনার মুখে ঐ সমুদয় বৃত্তান্ত পুনরায় শ্রবণ করিতে এরূপ আগ্রহ প্রকাশ করিতেছি।”
ভীষ্ম কহিলেন, ‘বৎস। পুৰ্ব্বে ভগবান বেদব্যাস তত্ত্বজিজ্ঞাসু [তত্ত্ব জানিতে অভিলাষী] স্বীয়পুত্র শুকদেবকে যাহা কহিয়াছিলেন, এক্ষণে সেই পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পুৰ্ব্বে মহাত্মা শুকদেব বেদবেদাঙ্গ, সাঙ্গ-উপনিষদসমুদয় অধ্যয়নপূর্ব্বক ধৰ্ম্মে নৈপুণ্য লাভ করিয়া যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য্য অনুষ্ঠান করিতে অভিলাষী হইয়া ধর্ম্মার্থসংশয়ের [ধর্ম্ম ও অর্থবিষয়ক সন্দেহের] ছেদনকৰ্ত্তা স্বীয় পিতা বেদব্যাসকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “পিতঃ প্রাণীগণের কৰ্ত্তা কে? কাল পরিমাণদ্বারা কি নিশ্চয় করা যায় এবং ব্রাহ্মণের কর্ত্তব্য কি, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।’
‘তখন সৰ্ব্বধর্ম্মবিশারদ ব্রহ্মজ্ঞ ভূতভবিষ্যবেত্তা ভগবান বেদব্যাস স্বীয় পুত্রকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘বৎস! আদ্যক্তশূন্য, জন্মবিহীন, জ্যোতিঃস্বরূপ, অজর, নিত্য, অব্যয়, তর্কের অগোচর ও জ্ঞানাতীত পরব্রহ্ম সমুদয় লোকের অগ্রে অবস্থান করিতেছেন। মহর্ষিগণ পঞ্চদশ নিমেষপরিমিত কালকে কাষ্ঠা, ত্রিংশৎকাষ্ঠাপরিমিত কালকে কলা, সাৰ্দ্ধদ্বাবিংশতি [সাড়ে বাইশ] পলাধিক ত্রিংশতকলাপরিমিত কালকে মুহূর্ত্ত, ত্রিংশমুহূৰ্তপরিমিত কালকে দিবারাত্রি, ত্রিংশৎদিবারাত্রিপরিমিত কালকে মাস ও দ্বাদশমাসপরিমিত কালকে সংবৎসর বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। সাংখ্যবিং পণ্ডিতেরা সংবৎসরকে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নদ্বারা বিভাগ করিয়া থাকেন। সূৰ্য্য স্বীয় গতিদ্বারা মানবগণের এই দিবারাত্রি সম্পাদন করিতেছেন। প্রাণীগণ দিবাভাগে স্বীয় স্বীয় কার্য্যে ব্যাপৃত থাকে এবং রাত্রিকালে নিদ্রাসুখ অনুভব করে। মনুষ্যগণের একমাসে পিতৃলোকের একদিন ও একরাত্রি হয়। তন্মধ্যে শুক্লপক্ষ তাঁহাদের দিন ও কৃপক্ষ রাত্রি। মানবগণের এক সংবৎসরে দেবলোকের একদিন ও একরাত্রি হয়, তন্মধ্যে উত্তরায়ণ তাঁহাদের দিবা ও দক্ষিণায়ন রাত্রি। পূৰ্ব্বে এই মানুষলৌকিক যে-যে দিবারাত্রি কথিত হইয়াছে, আমি সেই দিবারাত্রি গণনা করিয়া ব্রহ্মার দিবারাত্রি ও সংবৎসর আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
“দেবতাদিগের চারি সহস্র আট শত বৎসরে সত্য, তিন সহস্র ছয় শত বৎসরে ত্রেতা, দুই সহস্র চারি শত বৎসরে কলিযুগ হইয়া থাকে। এই চতুর্য্যগরূপ কাল প্রতিনিয়ত লোকসমুদয়কে ধারণ করিতেছে। এই কালই ব্ৰহ্মজ্ঞ ব্যক্তির পরিজ্ঞাত পরব্রহ্মস্বরূপ। সত্যযুগে চারিপাদ ধর্ম্ম ও সত্য প্রতিষ্ঠিত থাকে। তৎকালে কোন ব্যক্তিই কোনরূপ অধর্ম্মে প্রবৃত্ত হয় না। অন্যান্য যুগে ক্রমে ক্রমে বেদবিহিত ধর্ম্মের এক-এক অংশ ক্ষয় হইয়া যায়। সুতরাং তৎকালে ক্রমশঃ চৌর্য্য, মিথ্যা ও হিংসাদিদ্বারা অধৰ্ম্মের বৃদ্ধি হইতে থাকে। সত্যযুগে মানবগণ রোগবিহীন ও সিদ্ধিকাম হইয়া চারি শত বৎসর জীবিত থাকে। ত্রেতাযুগে তিন শত, দ্বাপরযুগে দুই শত ও কলিযুগে এক শত বৎসর মানবগণের পরমায়ু হয়। ঐ সমুদয় যুগে তাঁহাদের বেদবিহিত ধৰ্ম্ম, ক্রিয়াফল ও বেদের ফল ক্ষয় হইয়া যায়। ক্রমশঃ যুগহ্রাসনিবন্ধন সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চারিযুগে লোকের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম্ম নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। সত্যযুগে তপস্যা, ত্রেতাযুগে জ্ঞানোপার্জ্জন, দ্বাপরযুগে যজ্ঞ ও কলিযুগে দানই পরম ধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। এইরূপে চারিযুগে দেবমানের দ্বাদশ সহস্র বৎসর হইয়া থাকে। এইরূপ সহস্র যুগ অতীত হইলে তাঁহার একরাত্রি হয়। ব্রহ্মার দিবসে জন্তু প্রভৃতির সৃষ্টি হয় ও রাত্রিতে প্রলয় হইয়া থাকে। প্রলয়ের প্রারম্ভে ঈশ্বর এই বিশ্বসংসার আপনাতে লীন করিয়া যোগনিদ্রায় নিদ্রিত হইয়া শয়ন করেন এবং প্রলয়ের অবসান হইলেই জাগরিত হয়েন। দিবারাত্রিবেত্তা পণ্ডিতেরা এইরূপে দেবতাদিগের সহস্র যুগে ব্রহ্মার একদিন ও অপর সহস্র যুগে তাঁহার একরাত্রি অবধারিত করিয়াছেন। নিদ্রার অবসানে সেই অক্ষয় ব্রহ্মস্বরূপ ঈশ্বর জাগরিত হইয়া অহঙ্কারের সৃষ্টি করেন। সেই অহঙ্কারে পঞ্চভূতাত্মক মনের সৃষ্টি হয়। ‘