২২৯. মহর্ষি মন্দপালের উপাখ্যান, অপুত্রক মন্দপালের অগতি, শার্ঙ্গকচতুষ্টয়ের উৎপত্তি
ঊনত্রিংশধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
জনমেজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, হে ব্ৰহ্মন্! সেই খাণ্ডববন দাহকালে অশ্বসেন ও ময়দানব যেরূপে পরিত্রাণ পাইল, তাহা শুনিয়াছি; এক্ষণে শার্ঙ্গদিগের অনাময় কারণ শ্রবণ করিতে সাতিশয় ঔৎসুক্য হইতেছে, আপনি অনুগ্ৰহ করিয়া কীর্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে শত্রুনিপাতন! শার্ঙ্গকচতুষ্টয় যে নিমিত্ত সেই প্রবল খাণ্ডববনানল হইতে পরিত্রাণ পাইল, তদ্বিষয় সবিশেষ বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন। মন্দপাল নামে এক পরম ধাৰ্মিক তপঃপরায়ণ বেদপারগ মহর্ষি ছিলেন। ঐ তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন জিতেন্দ্রিয় তপোধন উদ্ধরেতাঃ ঋষিগণের আচরিত মার্গ অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিয়দ্দিনানন্তর তিনি তপস্যার পরাকাষ্ঠায় উত্তীর্ণ হইয়া দেহত্যাগপূর্বক পিতৃলোকে গমন করিলেন; কিন্তু তথায় তপস্যার ফল প্রাপ্ত হইলেন না। মহর্ষি বহুদিনানুষ্ঠিত তপস্যা। নিষ্ফল হইল দেখিয়া ধর্মরাজের সমীপ দেবগণকে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে সুরগণ! আমি কি নিমিত্ত বহুদিবসজ্জিত তপস্যার ফলভোগে বঞ্চিত হইলাম, বলুন। আমি, মর্ত্যলোকে কোন কর্তব্য কর্মের অনুষ্ঠান করি নাই, যাহাতে আমায় তপস্যা নিষ্ফল হইল; আমি এক্ষণেই তাহা করিতেছি। হে দেবগণ! মদনুষ্ঠিত তপস্যার ফল কি, আজ্জা করুন।
দেবগণ কহিলেন—হে ব্ৰহ্মন্! মনুষ্য জন্মিবামাত্র দেবঋণ, ঋষিঋণ ও পিতৃঋণ, এই ঋণত্রয়গ্রস্ত হয়। ঐ ঋণয়ের মধ্যে যজ্ঞদ্বারা দেবঋণ, তপস্যা দ্বারা ঋষিঋণ ও সন্তানোৎপাদনদ্বারা পিতৃঋণ হইতে মুক্ত হইতে পারে। তুমি তপশ্চরণ ও যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছ, কিন্তু তোমার সন্তান নাই; এই নিমিত্ত তোমার সমুদায় কর্ম নিষ্ফল হইয়াছে। অতএব তুমি পরম যত্নসহকারে অপত্যোৎপাদন কর, তাহা হইলেই এই অমরলোকে পয়সুখসমৃদ্ধি ভোগ করিতে পারিবে। হে দ্বিজোত্তম! শাস্ত্র কথিত আছে যে, পুত্র পিতাকে পুন্নাম নরক হইতে পরিত্রাণ কর্মে, অতএব তুমি অবিলম্বে অপত্যোৎপাদনে যত্নবান হও।
মহর্ষি মন্দপাল দেবগণের সেই বাক্য শ্রবণানন্তর কিরূপে অল্পকালমধ্যে বহু অপত্য উৎপাদন করিবেন, তদ্বিষয়িণী চিন্তা করিতে লাগিলেন। তিনি ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বহু প্রসবশালী বিহঙ্গমমশুলৈ গমন করত শাঙ্গাকমূর্তি ধারণপূর্বক জরিতানাম্নী এক শার্জিকায় গর্ভে চারিটি ব্ৰহ্মবাদী পুত্র উৎপাদন করিলেন। সেই পুরুষচতুষ্টয় অণ্ডমধ্যস্থ থাকিতে থাকিতেই তাহাদিগকে জরিতার নিকট সমর্পণপূর্বক পিতার নিকট গমন করিলেন। জরিতা মহর্ষিকর্তৃক পরিত্যক্ত অণ্ডস্থ ঋষিগণকে পরিত্যাগ করিতে না পারিয়া প্রাণপণে তাহাদিগকে পোষণ করত খাণ্ডববনেই বাস করিতে লাগিলেন।
কিয়দ্দিনানন্তর ভগবান হুতাশন খাণ্ডববন দাহ করিবার মানসে তথায় আগমন করিলেন। ঐ সময়ে মহর্ষি মন্দপাল লপিতার সহিত সেই বনে ভ্রমণ করিতেছিলেন। তিনি অগ্নিকে দেখিবামাত্র তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া এবং স্বীয় সন্তানগণের বাল্যাবস্থা স্মরণ করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে সেই মহাতেজাঃ হুতাশনের স্তব করিতে লাগিলেন, হে অগ্নে! তুমি সমস্ত লোকের মুখস্বরূপ; তুমি হব্যবাহন; তুমি গুপ্তভাবে সর্বভূতের অন্তঃকরণে বিচরণ কর; কবিগণ তোমাকে অদ্বিতীয় ও ত্রিবিধ কহেন এবং তোমাকে অষ্টধা কল্পনা করিয়া যজ্ঞকর্ম নির্বাহ করেন। হে হতাশন। মহর্ষিগণ কহেন, তুমিই এই বিশ্ব সৃষ্টি করিয়াছ; তুমি না থাকিলে এই সমস্ত জগৎ ক্ষণকাল মধ্যে ধ্বংস হইয়া যায়; বিপ্রগণ স্ত্রী পুত্র সমভিব্যাহারে তোমাকে নমস্কার করিয়া স্বধর্মবিজিত ইষ্ট গতি প্রাপ্ত হন। হে অগ্নে! সজ্জনগণ তোমাকে আকাশবিলগ্ন সবিদ্যুৎ জলধর বলিয়া থাকেন; তোমা হইতে অস্ত্র সমুদায় নির্গত হইয়া সমস্ত ভূতগণকে দগ্ধ করে; হে জাতবেদঃ! এই সমস্ত চরাচর বিশ্ব তুমিই নিৰ্মাণ করিয়াছ; তুমি সর্বাগ্রে জলের সৃষ্টি করিয়া তৎপরে তাহা হইতে সমস্ত জগৎ উৎপাদন করিয়াছ; তোমাতেই হব্য ও কব্য যথাবির প্রতিষ্ঠিত থাকে; হে দেব! তুমি দহন; তুমি ধাতা; তুমি বৃহস্পতি; তুমি অশ্বিনীকুমার; তুমি মিত্র; তুমি সেমি এবং তুমিই পবন।”
ভগবান্ হুতাশন অমিততেজাঃ মহর্ষি মন্দপালের এই প্রকার স্তুতিবাক্য শ্রবণে অৎপয়োনাস্তি পরিতুষ্ট হইয়া কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন্! আমি তোমার স্তরে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি, এক্ষণে বল, তোমার কি অভিলাষ পূর্ণ করিব। তখন মহর্ষি কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, হে হব্যবাহন! আপনার নিকট আমার এই প্রার্থনা যে, যৎকালে আপনি খাণ্ডববন দহন করিবেন, অনুগ্রহ করিয়া আমার পুত্রগণকে পরিত্যাগ করিতে হইবে। ভগবান হব্যবহন ‘তথাস্তু’ বলিয়া মহর্ষির প্রার্থনা পূরণে সম্মতি প্রদান করিলেন এবং তৎক্ষণাৎ ভয়ঙ্কর বেগে খাণ্ডববনমধ্যে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন।