২২৭তম অধ্যায়
ধৈৰ্য্যধারণের সাফল্য—বলি-বাসবসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি আমাদিগের সমুদয় বিষয়ের উপদেষ্টা; অতএব নরপতি বন্ধুবিয়োগ বা রাজ্যনাশ জন্য ঘোরতর বিপদে নিমগ্ন হইলে তাঁহার কিরূপ বৃত্তি অবলম্বন করা উচিত, আপনি তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! স্ত্রীপুত্ৰবিয়োগ বা ধননাশনিবন্ধন ঘোরতর ব্যসন উপস্থিত হইলে লোকের ধৈৰ্য্য অবলম্বন করাই শ্রেয়ঃ, ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিলে শরীর বিশীর্ণ হয় না। শোকবিহীন ব্যক্তির সততই সুখ ও আরোগ্যলাভ হইয়া থাকে। আরোগ্যলাভ হইলেই শরীরের ক্লান্তিপুষ্টি [শ্রীবৃদ্ধি] হয়। যে বিঘ্ন ব্যক্তি সাত্ত্বিকবৃত্তি অবলম্বন করেন, তাঁহারই ধৈৰ্য্য, ঐশ্বৰ্য্য ও সকাৰ্য্যে উৎসাহ হইয়া থাকে। এই স্থলে বলি-বাসবসংবাদ নামক পুরাতন ইতিহাসটি পুনরায় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
“পূৰ্ব্বকালে দেবদানবের ঘোরতর সংগ্রাম হইয়াছিল। ঐ যুদ্ধে অসংখ্য দেবদানবের প্রাণসংহার হয়। পরিশেষে সেই তীব্রতর সমরানল নির্ব্বাপিত হইলে দৈত্যরাজ বলি ত্রিলোকের অধীশ্বর হইয়াছিলেন। কিয়দ্দিন পরে ভগবান বিষ্ণু বামনরূপী হইয়া বলিকে বঞ্চনা করিয়া ইন্দ্রকে ত্রৈলোকের আধিপত্য প্রদান করিলেন। ইন্দ্র ত্রিলোকের অধিপতি হইলে দেবতারা মহাসমারোহে যজ্ঞ আরম্ভ করিলেন; চারিবর্ণের নিয়ম সংস্থাপিত হইল। ত্রিলোক সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠিল এবং ভগবান্ স্বয়ং যারপরনাই আহ্লাদিত হইলেন। ঐ সময় দেবরাজ ইন্দ্র অশ্বিনীকুমারদ্বয়, রুদ্র, বসু, আদিত্য, ঋষি, গন্ধৰ্ব্ব, ভুজগেন্দ্র [সর্পরাজ বাসুকি], সিদ্ধ ও অন্যান্য দেবগণে পরিবৃত হইয়া ঐরাবতনামক চতুর্দ্দন্ত বারণে আরোহণপূৰ্ব্বক ত্রিলোক পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। একদা তিনি ইতস্ততঃ পর্য্যটন করিতে করিতে সমুদ্রতীরে এক গিরিগহ্বরে দানবরাজ বলিকে অবলোকন করিয়া তাঁহার সমীপে উপস্থিত হইলেন। দানবরাজ দেবরাজকে দেবগণের সহিত ঐরাবতপৃষ্ঠে অবস্থিত অবলোকন করিয়া কিছুমাত্র ব্যথিত বা অনুতপ্ত হইলেন না। দেবরাজ তাঁহাকে অবিকৃত [বিকারহীন] ও নির্ভীক নিরীক্ষণ করিয়া ঐরাবতপৃষ্ঠ হইতে কহিলেন, ‘দানবেশ্বর! তোমাকে যে কিছুমাত্র ব্যথিত দেখিতেছি না, ইহার তাৎপর্য্য কি? তুমি কি শৌর্য্য, বৃদ্ধসেবা বা তপানুষ্ঠান বা ধৈৰ্য্যপ্রভাবে ঐরূপ শান্তি লাভ করিয়াছ? সহসা নির্ব্বিকার হওয়া নিতান্ত সুকঠিন। তুমি ইতিপূৰ্ব্বে পিতৃপিতামহোপভুক্ত [পিতাপিতামহের অধিকৃত—পৈতৃক] সিংহাসনে অধিরোহণপূৰ্ব্বক স্বজাতিমধ্যে শ্রেষ্ঠতা লাভ করিয়া অত্যুৎকৃষ্ট বিষয়ভোগ করিয়াছিলে; কিন্তু এক্ষণে শত্রুগণ তোমাকে সিংহাসনচ্যুত ও রাজ্যভ্রষ্ট করিয়া তোমার সহধর্ম্মিণীকে অপহরণ করিয়াছে। তুমি বরুণের পাশে বদ্ধ ও আমার বজ্ৰাস্ত্রে আহত হইয়া আমাদিগের অধীন হইয়াছ। আর এখন তোমার সেই শ্রী ও সেই রূপ বিভব নাই; তথাপি যে শোক হইতেছে না, ইহার কারণ কি? এরূপ অবস্থায় অবিকৃতচিত্তে অবস্থান করা নিতান্ত সুকঠিন। তোমার কি চমৎকার ধৈৰ্য্য! ত্রিলোকের আধিপত্যবিনাশ হইলে তোমা ভিন্ন আর কোন ব্যক্তি জীবন ধারণ করিতে সমর্থ হয়?’
অহঙ্কারপরিহারার্থ ইন্দ্রের প্রতি বলির উপদেশ
“দেবরাজ গর্ব্বিতভাবে এইরূপ পরুষবাক্য প্রয়োগ করিলে দৈত্যাধিপতি বলি অসম্ভ্রান্তচিত্তে [অকুণ্ঠিত হৃদয়ে] তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘দেবরাজ! তুমি আমাকে বিস্তর তিরস্কার করিলে; কিন্তু আমি এক্ষণে নিতান্ত নিগৃহীত হইয়াছি; অতএব এ সময় আমাকে তিরস্কার করাতে তোমার কিছুমাত্র গৌরব প্রকাশ করা হইতেছে না। আজ আমি তোমাকে বজ্র উত্তোলনপূৰ্ব্বক আমার সম্মুখে উপস্থিত হইতে দেখিলাম। এক্ষণে বুঝিলাম, তুমি পূর্ব্বে নিতান্ত অশক্ত ছিলে, এক্ষণে কিঞ্চিৎ সামর্থ্য প্রাপ্ত হইয়াছ; তুমি ভিন্ন আর কোন ব্যক্তিই এক্ষণে আমার প্রতি এরূপ ক্রূরবাক্য প্রয়োগ করিতে পারে না। শত্রু বশীভূত হইলে যে ব্যক্তি নিগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াও তাহার প্রতি দয়া প্রকাশ করে, সেই পুরুষ বলিয়া পরিগণিত হয়। দুই ব্যক্তি পরস্পর বিবাদ করিয়া সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলে, কে জয়লাভ করিবে, তাহার নিশ্চয় থাকে না। যুদ্ধে এক ব্যক্তির পরাজয় ও এক ব্যক্তির জয়লাভ হয়। অতএব তুমি বিক্রমপ্রভাবে সৰ্ব্বভূতের অধিপতিকে পরাজিত করিয়াছ মনে করিয়া গর্ব্বিত হইও না। তুমি ও আমি আমরা উভয়ে আমাদের ইদানীন্তন উন্নতি ও অবনতির কারণ নহি। পূৰ্ব্বে আমার যেরূপ আধিপত্য ছিল, এক্ষণে তুমি তাহা লাভ করিয়াছ; কিন্তু কালক্রমে তোমাকেও আমার মত দুরবস্থা প্রাপ্ত হইতে হইবে। অতএব তুমি আমাকে পরাজয়পূৰ্ব্বক দুষ্কর কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছ বোধ করিয়া আমার প্রতি অবজ্ঞা করিও না। লোকে পর্য্যায়ক্রমে সুখদুঃখ ভোগ করিতেছে; তুমিও পৰ্য্যায়ক্রমে ইন্দ্রত্বলাভ করিয়াছ, বস্তুতঃ তুমি কাৰ্য্যদ্বারা ত্রিলোক পরাজিত কর নাই।
‘আমরা উভয়েই কালের বশীভূত হইয়া রহিয়াছি; এই নিমিত্ত আমি তোমার ন্যায় আধিপত্য লাভ করিতে পারিতেছি না এবং তুমিও আমার ন্যায় দুর্দ্দশাপন্ন হইতেছ না। কাল মনুষ্যকে দুঃখিত করিতে ইচ্ছা করিলে মনুষ্য কখনই পিতামাতার শুশ্রূষা বা দেবপূজাপ্রভাবে সুখী হইতে পারে না। কি বিদ্যা, কি তপস্যা, কি দান, কি বন্ধুবান্ধব, কেহই কালনিপীড়িত ব্যক্তিকে পরিত্রাণ করিতে সমর্থ নহে। মনুষ্যেরা কালসহকারে সমুদ্ভূত বুদ্ধিবল ব্যতীত শত শত উপায়দ্বারাও আগামী অনর্থের প্রতিবিধান করিতে সমর্থ হয় না। কালক্রমাগত দুঃখদ্বারা নিপীড়িত ব্যক্তির পরিত্রাতা কেহই নাই; অতএব যখন সকল কাৰ্য্যই কালপ্রভাবে হইতেছে, তখন তুমি যে আপনাকে কর্ত্তা বলিয়া বিবেচনা কর, ইহা নিতান্ত দুঃখের বিষয়। যদি, লোকে কার্য্যের কৰ্ত্তা হইত, তাহা হইলে কেহই তাহার উৎপাদক থাকিত না; অতএব যখন লোক অন্য হইতে উৎপন্ন হইতেছে, তখন তাহাকে কিরূপে কৰ্ত্তা বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে? আমি কালক্রমে তোমাকে জয় করিয়াছিলাম এবং তুমিও কালক্রমে আমাকে জয় করিয়াছ। লোকে কালের বশীভূত হইয়াই স্ব স্ব কাৰ্য্যসম্পাদনার্থ ধাবমান হয়। সমুদয় লোকই কালের বশীভূত হইয়া রহিয়াছে। একবার অবশ্যই যে প্রলয়কাল সমুপস্থিত হইবে, তাহা তুমি প্রাকৃত বুদ্ধিদ্বারা বুঝিতে পারিতেছ না। তুমি স্বীয় পরাক্রমপ্রভাবে ইন্দ্ৰত্বলাভ করিয়াছ বোধ করিয়া কেহ কেহ তোমাকে প্রশংসা করে বটে, কিন্তু আমার হাতে কিছুমাত্র অনুতাপ হয় না। লোকপ্রবৃত্তিজ্ঞ [লোকরুচিতে অভিজ্ঞ] মাদৃশ ব্যক্তিরা দুঃখের অবস্থায় আপনাদিগকে কালপীড়িত বুঝিতে পারিয়া কি কখনও শোক ও মোহের বশীভূত হয়? আমার বা মাদৃশ ব্যক্তির বুদ্ধি কি কখন কালক্রমাগত ব্যসনসময়ে ভগ্ন অর্ণবপোতের ন্যায় অবসন্ন হইয়া থাকে? কি তুমি, কি আমি, কি অন্যান্য ভাবী সুরপতিগণ, সকলকেই পূর্ব্বতন ইন্দ্রদিগের গতি প্রাপ্ত হইতে হইবে।
‘তোমাকে এক্ষণে অপূৰ্ব্ব শোভাসম্পন্ন ও দুর্দ্ধর্ষ দেখিতেছি, কিন্তু উপযুক্ত কাল উপস্থিত হইলে তুমিও আমার তুল্য অবস্থায় অবস্থান করিবে। কালবশতঃ বহু সহস্র ইন্দ্রের পতন হইয়া গিয়াছে; অতএব কেহই কালকে অতিক্রম করিতে পারে না। তুমি ত্রিলোকের আধিপত্য লাভ করিয়া সৰ্ব্বভূতভাবন সনাতন ব্রহ্মার ন্যায় আপনাকে প্রধান বলিয়া জ্ঞান করিতেছ। কাহারই ঐশ্বৰ্য্য অচল ও চিরস্থায়ী নহে। তুমি কেবল স্বীয় মূঢ়ত্বনিবন্ধনই স্বীয় ঐশ্বর্য্য অনন্ত বোধ করিতেছ। লোকে কালকর্ত্তৃক বঞ্চিত হইয়াই অবিশ্বস্তবিষয়ে বিশ্বাস ও অনিশ্চয় বিষয়কে নিশ্চয় বলিয়া বোধ করিয়া থাকে। তুমি মোহবশতঃই রাজলক্ষ্মীকে আপনার বলিয়া বিবেচনা করিতেছ; কিন্তু কি তুমি, কি আমি, কি অন্য কোন ব্যক্তি, কেহই ইহাকে চিরকাল আয়ত্ত করিয়া রাখিতে পারে না। পূৰ্ব্বে ইনি ক্রমে ক্রমে অসংখ্য ব্যক্তিকে আশ্রয় ও পরিত্যাগ করিয়াছেন। এক্ষণে তোমার নিকট অবস্থান করিতেছেন বটে; কিন্তু কিয়ৎকাল পড়ে গাভী যেমন এক স্থান পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অন্যত্র গমন করে, তদ্রূপ নিশ্চয়ই তোমাকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অন্য ব্যক্তিকে আশ্রয় করিবেন।
‘তোমার পূৰ্ব্বে অসংখ্য ব্যক্তি ইন্দ্র হইয়াছিলেন এবং তোমার পরেও অনেকে ইন্দ্ৰত্বলাভ করিবেন। পূৰ্ব্বে যাঁহারা এই বৃক্ষৌষধি[বৃক্ষ ও পুষ্টিকর ওষধিলতা]পূর্ণ, নানারত্নসম্পন্ন, সসাগরা পৃথিবী ভোগ করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহারা সকলেই নয়নপথের বহির্ভূত হইয়াছেন। পৃথু, ঐল, ময়, ভীম, নরক, শম্বর, অশ্বগ্রীব, পুলোমা, রাহু, অমিতধ্বজ, প্রহ্লাদ, নমুচি, দক্ষ, বিপ্রচিত্তি, বিরোচন, হ্রীনিষেব, সুহোত্র, ভূরিহা, পুষ্পবান্, বৃষ, সতোপ্স , ঋষভ, বাহু, কপিলাশ্ব, বিরূপক, বাণ, কার্ত্তম্বর, বহ্নি, বিশ্বদংষ্ট্র, নর্ঋতি, সঙ্কোচ, বরীতাক্ষ, বরাহ, অশ্ব, রুচিপ্রভ, বিশ্বজিৎ, প্রতিরূপ, বৃষাণ্ড, বিক্ষর, মধু, হিরণ্যকশিপু ও কৈটভ প্রভৃতি মহাবল পরাক্রান্ত অসংখ্য দৈত্যদানবগণ ও বহুসংখ্যক রাক্ষসগণ রাজ্যাধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহারা সকলেই কালক্রমে পৃথিবী পরিত্যাগপূৰ্ব্বক লোকান্তরে গমন করিয়াছেন। অতএব কালই সৰ্ব্বাপেক্ষা বলবান্। হে দেবরাজ! তুমিই যে একাকী একশত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছ, এরূপ নহে। ভূতপূৰ্ব্ব ইন্দ্রগণ সকলেই শতযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন এবং সকলেই ধর্ম্মপরায়ণ, যজ্ঞে দীক্ষিত, বিমানচারী, সম্মুখসংগ্রামে অনুরক্ত, অস্ত্রবলসম্পন্ন, মায়াধারী ও কালরূপী ছিলেন। তাঁহাদের সকলেরই বাহু পরিঘের ন্যায় আয়ত ছিল। তাঁহাদের মধ্যে কাহাকেও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া পরাঙ্মুখ হইতে শ্রবণ করা যায় নাই। তাঁহারাও দাক্ষায়ণীগর্ভম্ভূত[দাক্ষায়ণী দিতি ও দনুগর্ভজাত], মহাবলপরাক্রান্ত, তেজঃপুঞ্জ কলেবর, মহাপ্রতাপশালী, সত্যব্রত ও দেবব্রতপরায়ণ, সমুদয় শাস্ত্রে পারদর্শী এবং যথেষ্ট ঐশ্বর্য্যের অধিপতি ছিলেন এবং সকলেই উপযুক্ত পাত্রে ধনদান করিতেন; কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে কাহারও কখন ধনদর্প বা মৎসরতা লক্ষিত হয় নাই। যাহা হউক, কালের নিকট কেহই অব্যাহতিলাভে সমর্থ নহে। তাঁহাদিগকে কালকর্ত্তৃক কবলিত হইতে হইয়াছে।
‘হে দেবরাজ! এই ধরিত্রীর উপভোগ সমাপ্ত হইলে যখন তোমাকে ইহা পরিত্যাগ করিতে হইবে, তখন তুমিও স্বীয় শোকাবেগ সংবরণে সমর্থ হইবে না। অতএব ভোগাভিলাষ ও ঐশ্বৰ্য্যগর্ব্ব পরিত্যাগ কর। আমার মত রাজ্যনাশ হইলে তোমাকেও শোক দুঃখ সহ্য করিতে হইবে। অতএব তুমি শোকের সময় শোক ও আহ্লাদে অভিভূত হইও না। অতীত ও অনাগত বিষয়ের চিন্তা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বর্ত্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকা সকলেরই উচিত। আমি আলস্যপরিত্যাগপূৰ্ব্বক সতত স্বকার্য্যে নিরত থাকিতাম; অতএব কাল যখন আমাকেও আক্রমণ করিয়াছে, তখন অচিরাৎ তোমাকেও আক্রমণ করিবে, সন্দেহ নাই; অতএব ক্ষান্ত হও। তুমি আমাকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করিয়া আমার ত্রাসোৎপাদন করিতে চেষ্টা পাইতেছ এবং আমি নিপীড়িত হইয়াছি বলিয়াই আত্মাভিমান প্রকাশ করিতেছ। আমি পূর্ব্বে কালকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াছি বলিয়াই তুমি আমার নিকট মহা তর্জ্জন-গর্জ্জন করিতেছ; কিন্তু ইহা স্থির করিয়া রাখ যে, সেই কাল তোমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইতেছে।
‘পূৰ্ব্বে আমি রোষাবিষ্ট হইয়া সমরসাগরে অবতীর্ণ হইলে, কে আমার সম্মুখে অবস্থান করিতে সমর্থ হইত? এখন তোমার সৌভাগ্য সমুদিত হইয়াছে বলিয়াই তুমি আমার সম্মুখে অবস্থান করিতে সমর্থ হইতেছ। এখন তুমি স্বর্গে ইন্দ্রত্ব করিতেছ; কিন্তু তোমারও সহস্র বৎসর পরিপূর্ণ হইবে। তখন আমি যেমন দানবেন্দ্রপদবী হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া অসুখী হইয়াছি, তোমাকেও এইরূপ হইতে হইবে। তুমি কোন সকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া এই বিচিত্র জীবলোকের ইন্দ্ৰত্বলাভ কর নাই, আর আমিও কোন অসৎকার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া ইহা হইতে পরিভ্রষ্ট হই নাই। কালই আমাদের উন্নতি ও অবনতির কারণ। বিদ্বান্ ব্যক্তিরা কি ঐশ্বৰ্য্য, কি অনৈশ্বৰ্য্য, কি সুখ, কি দুঃখ, কি জন্ম, কি মৃত্যু, কিছুতেই সমধিক প্রীত বা ব্যথিত হয়েন না। আমরা পরস্পর পরস্পরকে বিলক্ষণ অবগত আছি; তবে তুমি নির্লজ্জ হইয়া কি নিমিত্ত আমাকে ভৎসনা করিতেছ? ইতিপূৰ্বেই তুমি আমার পরাক্রমের বিশেষ পরিচয় প্রাপ্ত হইয়াছ। আমার সমরাঙ্গনে বিক্রমপ্রকাশই তাহার দৃষ্টান্তস্বরূপ রহিয়াছে। আমি পূৰ্বে আদিত্য, রুদ্র, সাধ্য, বসু ও মরুদ্গণকে পরাজয় করিয়াছিলাম। দেবাসুরযুদ্ধসময়ে দেবগণ যে আমার নিকট পরাস্ত হইয়াছিলেন, তাহা তুমি বিলক্ষণ অবগত আছ। আমি বারংবার তোমার মস্তকে হিংস্ৰজন্তুসমাকীর্ণ বহুকাননসমন্বিত পর্ব্বতসমুদয় চূর্ণ করিয়াছি। কিন্তু এখন কি করি, কালকে অতিক্রম করা নিতান্ত সুকঠিন। যদি কাল আমাকে আক্রমণ না করিত, তাহা হইলে আমি এক মুষ্টিপ্রহারে তোমাকে তোমার বর্জ্যের সহিত নিপাতিত করিতে সমর্থ হইতাম। যাহা হউক, এখন আমার বিক্রমপ্রকাশের সময় নহে, ক্ষমা করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে; এই নিমিত্তই তোমার তিরস্কারবাক্যসকল সহ্য করিলাম।
‘আমি কালাগ্নিপরিবেষ্টিত ও কালপাশে বদ্ধ হইয়াছি বলিয়াই তুমি আমাকে ভৎসনা করিতেছ। দুরক্ৰিমণীয় কালরূপী ভীষণ পুরুষ পশুর ন্যায় আমাকে বন্ধন করিয়া অবস্থান করিতেছেন। লাভালাভ, সুখদুঃখ, জন্মমৃত্যু ও বন্ধমোক্ষ সমুদয়ই কালক্রমে সংঘটিত হইয়া থাকে। তুমি বা আমি আমরা কেহই কোন বিষয়ের কৰ্ত্তা নহি। কালই সমুদয় বিষয়ের কর্ত্তা। সেই কাল আমাকে বৃক্ষস্থিত ফলের পরিপক্কাবস্থায় সমানীত করিয়াছে। পুরুষ এক সময় যেসকল কার্য্যের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক সুখী হইয়া থাকে, কালক্রমে সেইসমুদয় কাৰ্য্যের অনুষ্ঠানদ্বারাই তাহাকে দুঃখভোগ করিতে হয়; অতএব যে ব্যক্তি কালের মহিমা অবগত থাকে, কাল তাহাকে আক্রমণ করিলে তাহার শোক করা কর্ত্তব্য নহে। বিশেষতঃ শোক করিলে কখন দুঃখের শান্তি হয় না, প্রত্যুত সামর্থ্যেরই হ্রাস হইয়া থাকে, এই নিমিত্তই আমি শোকে বিরত হইয়াছি।
ইন্দ্রকর্ত্তৃক ধৈর্য্যশীল বলির প্রশংসা
“দৈত্যেশ্বর বলি এই কথা কহিলে, ভগবান্ পাকশাসন ক্রোধ সংবরণপূৰ্ব্বক তাঁহাকে কহিলেন, ‘দানবরাজ! বরুণের পাশ ও আমার সবজ্র বাহু সমুদ্যত দেখিয়া অন্যের কথা দূরে থাকুক, জিঘাংসাপরতন্ত্র মৃত্যুকেও ব্যথিত হইতে হয়। কিন্তু তুমি স্বীয় তত্ত্বদর্শিতাপ্রভাবে এক্ষণে কিছুমাত্র ব্যথিত হইতেছ না; অতএব নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে, ধৈৰ্য্যই তোমার ব্যথা না হইবার কারণ। কোন্ ব্যক্তি এই জগৎকে বিনশ্বর বুঝিতে পারিয়া অর্থ ও শরীরের প্রতি বিশ্বাস করে? আমিও তোমার ন্যায় সমুদয় লোককে অনিত্য ও গূঢ় কালানলে নিক্ষিপ্ত বলিয়া তাবগত আছি। ইহলোকে কি প্রধান, কি অপ্রধান সকলকেই কালকবলে নিপতিত হইতে হয়। কেহই কালের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইতে পারে না। কেহই কালের ঈশ্বর নহে। কাল অপ্রমত্তভাবে প্রতিনিয়ত প্রাণীগণকে শাসন করিতেছে। কাল সাবধান হইয়া প্রমত্ত ব্যক্তির নিকট জাগরিত রহিয়াছে। কাল সৃষ্টির প্রারম্ভ অবধি সকলের প্রতি সমভাবে আধিপত্য করিয়া আসিতেছে; কি পুরাতন, কি অধুনাতন কোন ব্যক্তিই উহাকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হয় নাই। বণিকেরা যেমন আপনাদিগের লভ্য বস্তুসমুদয় একত্র করে, তদ্রূপ কাল কাষ্ঠা, কলা, ক্ষণ, প্রহর, দিবারাত্রি ও মাস প্রভৃতি আপনার সূক্ষ্ম অংশসমুদয় একত্রিত করিয়া স্থূল করিতেছে। কালের কখন কোন ব্যতিক্রম দৃষ্টিগোচর হয় না। অনেকে “আজ আমি এই কাৰ্য্য করিব ও কল্য এই কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিব” বলিয়া স্থির করিয়া কালপ্রভাবে আপনাদের অভীষ্ট কাৰ্য্যসাধন করিবার পূৰ্বেই মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়। কালসমাক্রান্ত প্রাণীগণের মুখে “ইতিপূৰ্বেই আমি ইহাকে দর্শন করিয়াছি, আহা! কিরূপে ইহার মৃত্যু হইল,” এইরূপ সৰ্ব্বদা শ্রুত হইয়া থাকে। প্রাণীগণের অর্থ, ভোগ, স্থান, ঐশ্বৰ্য্য ও প্রাণ কিছুই চিরস্থায়ী নহে। কাল সমুদয়ই হরণ করিয়া থাকে। উচ্চবস্তুর নিপাত ও বিদ্যমান বস্তুর ধ্বংস অবশ্যই হইবে। ফলতঃ সমুদয় পদার্থই অনিত্য, এইরূপ নিশ্চয় করা অতিশয় দুষ্কর।
‘যাহা হউক, সমুদয় জগৎকে কালের বশীভূত ও অনিত্য বলিয়া স্থির করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। তোমার বুদ্ধি তত্ত্বদর্শনপরায়ণ ও অচল; এই নিমিত্তই তোমাকে ব্যথিত হইতে হয় না। তুমি পূৰ্ব্বে যে ত্রিলোকের অধীশ্বর ছিলে, এক্ষণে তাহা একবার মনেও করিতেছ না। কাল কি জ্যেষ্ঠ, কি কনিষ্ঠ, সকলকেই আক্রমণ করিয়া সংহার করে। মনুষ্যগণ কালকর্ত্তৃক প্রতিনিয়ত পরিচালিত হইয়াও ইহার প্রভাব বুঝিতে না পারিয়া ঈর্ষা, কাম, ক্রোধ, ভয়, স্পৃহা ও মোহে আসক্ত হইয়া থাকে। কিন্তু তুমি স্বীয় তপানুষ্ঠান, তত্ত্বজ্ঞান ও বিদ্যাপ্রভাবে করস্থ আমলকের ন্যায় [হস্তমধ্যে সমস্ত বস্তুদর্শন—হাতের মধ্যে ক্ষুদ্র আমলকীর ন্যায় সমস্ত জগৎ যে জ্ঞানবলে পরিদৃষ্ট হয়, তাহার নাম করামলক বিদ্যা।] কালকে উত্তমরূপে দর্শন করিতেছ। তোমাকেই কালনিয়মজ্ঞ সৰ্ব্বশাস্ত্রবিশারদ, কৃতাত্মা ও পণ্ডিতগণের পূজনীয় বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। বোধ হয়, তুমি বুদ্ধিপ্রভাবে সমুদয় লোক পরিজ্ঞাত হইয়া ও সৰ্ব্বত্র বিহার করিয়া মুক্তিলাভ করিয়াছ। বিষয়ানুরাগ ও মোহ কখনই তোমাকে আক্রমণ করিতে পারে না। তোমার আত্মা প্রীতি ও সন্তাপশূন্য। আমি তোমাকে সৰ্ব্বভূতের সুহৃদ, বৈরভাবশূন্য ও শান্তচিত্ত দেখিয়া তোমার প্রতি নিতান্ত প্রসন্ন হইয়াছি। ভবাদৃশ জ্ঞানবান্ ব্যক্তিকে বন্ধনদশায় বিনাশ করিতে আমার কিছুমাত্র ইচ্ছা নাই। এক্ষণে তোমার উপর আমার দয়ার সঞ্চার হইয়াছে। আমি আর তোমার প্রতি নৃশংস ব্যবহার করিব না। তোমার মঙ্গল হউক। কালক্রমে প্রজাগণ অধার্ম্মিক হইলে তুমি এই সমুদয় বারুণপাশ হইতে মুক্তিলাভ করিবে। যখন পুত্রবধূ শত্রুকে এবং পুত্র মোহবশতঃ পিতাকে কার্য্যে নিযুক্ত করিবে, শূদ্রগণ নির্ভয়ে ব্রাহ্মণগণদ্বারা পাদধাবন ও ব্রাহ্মণীতে গমন করিবে, পুরুষেরা অযোনিতে বীৰ্য্যক্ষেপ করিবে, কাংস্যপাত্ৰদ্বারা সম্মার্জ্জনী সংমার্জ্জিত [ঝাঁটা দিয়া সাফ করা] ধূলি নিক্ষিপ্ত ও অপবিত্র পাত্ৰদ্বারা পূজোপকরণ সমানীত হইবে এবং যখন চারি বর্ণ নিয়মবিহীন হইয়া উঠিবে, সেই সময় তুমি এক-একটি করিয়া সমুদয় পাশ হইতে বিমুক্ত হইবে। অতঃপর আমা হইতে তোমার আর কিছুমাত্র ভয় নাই। তুমি সুস্থচিত্ত ও নিরাময় হইয়া সুখে সময় প্রতীক্ষা কর।’
“ঐরাবতারূঢ় দেবরাজ দৈত্যের বলিকে ইহা কহিয়া অন্যান্য অসুরগণকে পরাজয়পূৰ্ব্বক ত্রৈলোক্যের একাধিপত্য লাভ করিয়া যারপরনাই আনন্দিত হইলেন। তখন মহর্ষিগণ তাঁহাকে স্তব করিয়া বিধিপূৰ্ব্বক হুতাশনে আহুতি প্রদান করিতে লাগিলেন। দেবগণ দেবরাজের নিকট অমৃত সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন। মহাতেজাঃ পুরন্দর এইরূপে অসুরবিনাশপূৰ্ব্বক ইন্দ্রত্ব লাভ করিয়া পরম আহ্লাদে সুরপুরে গমন করিলেন।”