২২৭. খাণ্ডববনে ইন্দ্রের বারিবর্ষণ, অর্জুনের বিরুদ্ধে দেবগণের যুদ্ধ
সপ্তবিংশত্যধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, তদনন্তর অর্জুন অসংখ্য শরবণবায় বারিবর্ষণ, নিবারণ করিলেন। যেমন নীহারজালে চন্দ্রমা সমাচ্ছন্ন হয়েন, তদ্রূপ অর্জুন শরজাল বিস্তারপূর্বক সমস্ত খাণ্ডবরন আচ্ছাদিত করিলেন। তদীয় শত্রু কলাপে অন্তরীক্ষ পরিব্যাপ্ত হইলে একটি প্রাণীও পলায়ন করিতে পারিল না। তৎকালে নাগরাজ তক্ষক কুরুক্ষেত্রে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহার পুত্র অশ্বসেন তথায় উপস্থিত ছিলেন, তিনি অগ্নি হইতে আত্মরক্ষা করিবার নিমিত্ত অশেষপ্রকার যত্ন করিলেন, কিন্তু অর্জুনের শরজালে অবরুদ্ধ হওয়াতে কোনক্রমেই বহির্গত হইতে সমর্থ হইলেন না। তদ্দর্শনে তাহার মাতা স্নেহ পরবশ হইয়া বিপন্ন পুত্রের রক্ষার্থে আসন্ন মৃত্যুমুখে ধাবমানা হইলেন। ইতিপূর্বে অশ্বসেনের মস্তক ও লাল দগ্ধ হইয়াছিল। নাগপত্নী অগ্নি হইতে পুত্রকে মুক্ত করিতে যাইয়া আপনি পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন। অর্জন তীক্ষ্ণধার শরধারা নাগভাৰ্যার মস্তকছেদন করিলেন। দেবরাজ তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া তক্ষকতনয়ের প্রাণরক্ষাৰ্থ বানবর্ষণ অর্জুনকে অচেতন করিলেন। ইত্যবসরে অশ্বসেন পলায়ন করিল। অর্জুন ইন্দ্রের মায়া ও সর্থের প্রবঞ্চনা পৰ্যালোচনা করত তত্র সমস্ত প্রাণীকে দ্বিধা ত্রিধা খণ্ড করিতে লাগিলেন। কৃষ্ণ, অর্জন ও পাক সেই জিহ্মগামীকে ‘নিরাশ্রয় হইবে’ বলিয়া অভিসম্পাত করিলেন।
অনন্তর ক্রোধাবিষ্ট জিষ্ণু পূর্বকৃত বঞ্চনা স্মরণ করিয়া আশুগ শরসমূহ দ্বারা বজ্রধরের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। দেবরাজ অর্জনকে সমরে সংবদ্ধ নিরীক্ষণ করিয়া অনবরত অস্ত্র নিক্ষেপে গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন করিলেন। প্রবল বায়ুবেগে সমুদ্র সকল সংক্ষোভিত হইয়া বেলাভুমি অতি ক্ৰম করিতে লাগিল, জলধারাবনত মেঘমালায় নভোমগুল সমাকুল হইল, ক্ষয়ে ক্ষণে বিদ্যুৎ, অবিশ্রান্ত বজ্রাঘাত ও ঘনঘটার গভীর গর্জনে যেন প্রলয়কাল উপস্থিত হইল। অর্জুন সেই ঘোরতর মেঘের নিরাকরণ করিবার নিমিত্ত অত্যুৎকৃষ্ট অসকল প্রয়োণ করিতে লাগিলেন। যুক্তিবিশারদ ধনজয়প্রথমতঃ মন্ত্রপূত বায়ব্যাস্ত্রদ্বারা অশনি ও মেঘের কলবীৰ্য্য তিরোহিত করিলেন। জলধারা শুরু ও ক্ষণপ্রভা বিলীন হইয়া গেল। এইরূপে ক্ষণকালমধ্যে ব্যোমতল তমোমুক্ত ও প্রশান্তরজ হইল, সুশীতল গন্ধবহ মন্দ মন্দ সঞ্চারে বহিতে লাগিল, অকর্মণ্ডল প্রকৃতিস্থ হইল এবং হুতাশন প্রাণিগণের দেহনিঃসৃত, বসাদ্বারা অভিষিক্ত হইয়া পুনরায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। অগ্নির শব্দে সমুদায় জগৎ পরিপূর্ণ হইল। সুপর্ণাদি পত্রিবর্গ কৃষ্ণাজ্জনকর্তৃক খাণ্ডববন পরিক্ষিত দেখিয়া গৰ্ব প্রদর্শনপূর্বক আকাশমার্গে উড্ডীন হইল। গরুড় বজ্রতুল্য স্বীয় নখ, তুণ্ড ও পক্ষদ্বারা কৃষ্ণার্জুনকে প্রহার করিবার মানসে আকাশ হইতে নামিলেন। উরগসমূহ দগ্ধানন হইয়া পাণ্ডবসমীপে তীব্র বিষ উদগার করিতে করিতে নিপতিত হইতে লাগিল। অর্জুন শরদ্বারা তাহাদিগকে খণ্ড খণ্ড করিলেন। তাহারা পুনৰ্বার প্রজ্বলিত হুতাশনে পতিত হইয়া ভস্মসাৎ হইল। যক্ষ, রাক্ষস, পয়গ, গন্ধর্ব ও অসুরগণ যুদ্ধার্থী হইয়া ঘোতর নিনাদ করত উত্থিত হইল। অর্জুন তীক্ষ্ণ শররা সেই ক্রোধমূৰ্জিত, জিঘাংসুদিগেয় মস্তকচ্ছেদন করিলেন। অরাতিকুলনিহন্তা কৃষ্ণ চক্রদ্বারা দৈত্যদানবগণের প্রাণ সংহার করিলেন। কেহ কেহ কৃষ্ণের চক্রাস্ত্রদ্বারা চালিত ও বাণবিন্ধ হওয়াতে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল।
অনন্তর দিশাধিপতি ইন্দ্র শ্বেতগজে অধিরূঢ় হইয়া কৃষ্ণার্জুনকে লক্ষ্য করিয়া ধাবমান হইলেন এবং অতি বেগে অশনিগ্রহণপূর্বক অপর কতকগুলি, অস্ত্র সৃষ্টি করিয়া সুরগণকে কহিলেন, এইবারে কৃষ্ণাজ্জন নিহত হইয়াছেন। দেবরাজ অশনি উদ্যত করিয়াছেন দেখিয়া, দেবতারা স্ব স্ব অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করিলেন। কৃতান্ত কালদণ্ড, ধনপতি গদা, বরুণ পাশ ও বজ্র, মহাবল স্কন্দ শক্তি গ্রহণ করিয়া সুমেরু পর্বতের ন্যায় দণ্ডায়মান হইলেন। অশ্বিনীকুমারেরা দীপ্যমান ওষধী, বিধাতা ধনু, জয় মুষল, বিশ্বকর্মা পর্বত, অংশ শক্তি, যম পরশু এবং সূৰ্য্য অতি ভয়ঙ্কর পরিধাস্ত্র গ্রহণপূর্বক মহা আস্ফালন করিতে লাগিলেন। মিত্র চক্র ধারণ করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন, পূষা, ভগ এবং সবিতা ক্রুদ্ধ হইয়া শরাসন ও নিস্ত্রিংশ গ্রহণ করিয়া কৃষ্ণার্জনের প্রতি ধাবমান হইলেন। রুদ্র, ব, মরুৎ, বিবে এবং অন্যান্য অসংখ্য দেবগণ কৃষ্ণৰ্জ্জুনের জিঘাংসায় বিবিধ অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্বক গমন করিলেন। দেবায়। রণক্ষেত্রে অত্যন্ত ব্যাপার সকল নিরীক্ষণ করিলেন এবং কল্পান্তসময়ের ন্যায় ভূতগণের মোহ উপস্থিত দেখিলেন। দেবগণসমভিব্যাহারী ইন্দ্রকে কোস্বিত অবলোকন করিয় যুদ্ধবিশারদ কৃষ্ণার্জুম সজ্য শাসন গ্রহণপূর্বক নির্ভয়ে জামান হইলেন। তাঁহারা অমর্যদীপ্ত হইয়া বসদৃশ শরসমূহদ্বারা শক্ত-সমভিব্যাহাৱী সুরগণকে দূরীকৃত করিলেন। দেবতারা বারংবার ভগ্নমনোরথ হইয়া ভয়ে যুদ্ধ পরিত্যাগপূর্বক ইন্দ্রের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। দেবতাদিগকে যুদ্ধে পরাঙ্মুখ দেখিয়া নভোমণ্ডলস্থিত ঋষিগণ সাতিশয় কিম্বয়া বিষ্ট হইলেন। দেবরাজও পুনঃপুনঃ তাঁহাদিগের বল, বীৰ্য্য ও অসামান্য রণনৈপুণ্য সন্দর্শনে পরম প্রীত হইলেন। পাকশাসন, অর্জুনের ভুজবীর্য পরীক্ষাথে অনবরত শিলাবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। অন অনায়াসে তাহা প্রতিহত করিলেন। তদ্দর্শনে শতক্রতু পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকরূপে অশ্মবর্ষণ আরম্ভ করিলেন, কিন্তু অর্জুনের বাণে সকলই লয় প্রাপ্ত হইল।
অনন্তর দেবরাজ জিঘাংসাপরতন্ত্র হইয়া স্বীয় বাহুবলে তরুলতার সহিত মন্দগিরির শিখর উৎপাটনপূর্বক অর্জনের প্রতি নিক্ষেপ করিলেম। অর্জুন অজিহ্মগ মহাবেগবাব শরসমূহদ্বারা সেই অদ্রিশৃঙ্গ শতধা বিচ্ছিন্ন করাতে বোধ হইল যেন, নভোমণ্ডল হইতে পতনোম্মুখ সূৰ্য্যমণ্ডল ও গ্রহগণ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইতেছে। গিরিশিখর খাণ্ডবনে পতিত হইবামাত্র অত্রস্থ সমস্ত প্রাণ যুগপৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।