২২২. খাণ্ডবদহন পর্বাধ্যায় – অর্জুনসহ যাদবগণের জলবিহার
দ্বাবিংশত্যধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,—পাণ্ডবগণ ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করত রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ও শান্তনব ভীষ্মের আদেশে অন্যান্য রাজগণকে বিনষ্ট করিলেন। যেমন জীবাত্মা সুলক্ষণসম্পন্ন সৎকর্মশালী পুরুষের শরীরে সুখে বাস করেন, সেইরূপ সমুদায় লোক পুণ্যকর্মা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে আশ্রয় করিয়া ইন্দ্রপ্রন্থে সুখে বাস করিতে লাগিলেন। নীতিমান ধর্মরাজ ধৰ্মাৰ্থকাম ত্রিবর্গ ও আত্মতুল্য ভ্রাতৃবর্গের প্রতি নির্বিশেষ অয়াগ করিতেন। রাজা স্বয়ং ধৰ্মার্থ কাম ত্রিবর্গের চতুর্থ মোক্ষের ন্যায় শোভাধিত হইলেন। বেদাধ্যয়নশীল, যজ্ঞশীল ও শিষ্টপ্রতিপালক ভূপালকে প্রাপ্ত হইয়া প্রজাগণের কমলা, অচঞ্চলা এবং বুদ্ধি ও ধর্মের উৎকর্ষ হইতে লাগিল। যেমন উচ্চাৰ্য্যমাণ বেদচতুষ্টয়দ্বারা জ্যোতিষ্টোমাদি মহৎ যজ্ঞ সুশোভিত হয়, রাজা যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃচতুষ্টয়ের সহিত তদ্রূপ নিরতিশয় শোভা প্রাপ্ত হইলেন। যেমন দেবতারা বেষ্টন করিয়া প্রজাপতির উপাসনা করেন, বৃহস্পতিতুল্য ধৌ্যাদি, ব্রাহ্মণগণও ভূপাল যুধিষ্ঠিরকে সেইরূপে উপাসনা করিতেন। যেমন নির্মল পূর্ণচন্দ্রের অবলোকনে প্রজাগণের নেত্র ও হৃদয়ম্প্রফুল্ল হয়, সেইরূপ ভুপাল যুধিষ্ঠিরকে প্রাপ্ত হইয়া তাহাদিগের নেত্র ও হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হইত। তাহার যে দৈবাধীন তাহার প্রজা হইয়াছে বলিয়া তাঁহার প্রতি অনুরক্ত থাকিত এমন নহে, রাজাও সর্বদা প্রজাগণের মনোরঞ্জন করিতেন। ধীমান্। মিষ্টভাষী যুধিষ্ঠিরের মুখ হইতে অনুচিত, মিথ্যা, অসহ বা অপ্রিয় বাক্য কদাচ নির্গত হইত না। মহাতেজাঃ যুধিষ্ঠির সতত আপনার ও অন্যের হিতসাধনেচ্ছু হইয়া পরম পরিতোষে কালাতিপাত করিতেন। সুস্থশরীর ও হৃষ্টচিত্ত পাণ্ডবেরা স্বকীয় তেজঃপ্রভাবে অন্যান্য রাজগণকে তাপিত করত ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করিতে লাগিলেন।
একদা অর্জুন কৃষ্ণকে কহিলেন, হে জনার্দন! গ্রীষ্মের অতিমাত্র প্রাদুর্ভাব হইয়াছে, অতএব আমরা সপরিবারে যমুনায় যাইয়া জলবিহার করিতে অভিলাষ করি; সায়ংকালে সকলে প্রত্যাগমন করিব, তোমার কি অভিরুচি হয়? বাসুদেব কহিলেন, হে অর্জুন! আমারও সম্পূর্ণ ইচ্ছা হইতেছে যে, আমরা সুহৃজ্জনপরিবৃত হইয়া যথেচ্ছ জলবিহার করি। বৈশপায়ন কহিলেন, কৃষ্ণ ও অর্জুন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অনুমতি লইয়া সুহৃদগণের সহিত যমুনায় গমন করিলেন। অনন্তর তাঁহারা নানাবিধ বৃক্ষে সমাকীর্ণ ইন্দ্রপুরসদৃশ, বিবিধ খাদ্যদ্রব্যযুক্ত ও সুগন্ধি মাল্যজালে পরিবৃত বিহারদেশে উপস্থিত হইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। তথায় সকলেই আনন্দে বিহার করিতে আরম্ভ করিলেন। বিপুলনিতম্বা পীনোন্নতপয়োধর মদস্থলিতগমন বামলোচনারা ক্রীড়ামদে মত্ত হইয়া উঠিল। কেহ বনবিহার, কেহ জলবিহার, কেহ বা গৃহমধ্যে বিহার করিতে লাগিল। দ্রৌপদী ও সুভদ্রা বিবিধ বিচিত্র বসন ও নানাবিধ অলঙ্কার কামিনীগণকে প্রদান করিলেন। কোন কামিনী হৃষ্টান্তকরণে নৃত্যগীত আরম্ভ করিল; কেহ ইসরস্বরে শব্দ করিতে লাগিল; কেহ হাস্য পরিহাসে মত্ত, হইল; কেহ অত্যুকৃষ্ট সুরাপান করিয়া গদগদস্বরে কথা কহিতে জাগিল; কেহ বা কাহার সহিত বিরোধ আরম্ভ করিল; কেহ বা নির্জন স্থানে যাইয়া গোপনীয় বিষয় লইয়া কথোপাকথন করিতে লাগিল এবং তত্র সমৃদ্ধিশালী অট্টালিকা সকল বেণু, বীণা ও মৃদঙ্গের সুমনোহর শব্দে পরিপূর্ণ হইল। অনন্তর মহাত্মা বাসুদেব ও অর্জুন এক মনোহর প্রদেশে গমন করিয়া মহামুল্য আসনে উপবেশন করিলেন। তাহারা আসনে উপবেশনপূর্বক অতীত ও অন্যান্য বৃতান্ত লইয়া নানাপ্রকার কথোপকথন করিতে লাগিলেন। কৃষ্ণার্জুন অশ্বিনীকুমারের ন্যায় আসনে উপবিষ্ট হইয়া আমোদ প্রমোদ করিতেছেন, ইত্যবসরে তপ্তকাঞ্চনসমিভ তরুণারুণসঙ্কাশ পিঙ্গোজ্জ্বল-শ্মশ্রুজালজড়িত জটাচীরধারী এক দীর্ঘকায় ব্রাহ্মণ আসিয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। তাহার সেই দ্বিজবরকে সমীপে আগত দেখিয়া আসন পরিত্যাগপূর্বক তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিলেন।