২১৫তম অধ্যায়
ধর্ম্মব্যাধের প্রতি ঋষিশাপের প্রত্যাহার
‘ব্যাধ কহিল, “হে দ্বিজবর! ঋষি কহিল, “হে দ্বিজবর! ঋষি এইরূপ অভিসম্পাত করিলে আমি তাহার শরণাগত হইয়া বিনয়নম্রবাক্যে নিবেদন করিলাম, ‘মহর্ষে! আমি অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত ঈদৃশ দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি, অতএব আপনি আমার প্রতি প্ৰসন্ন হইয়া ক্ষমা প্ৰদৰ্শন করুন।” ঋষি কহিলেন, “আমি যে শাপ প্ৰদান করিয়াছি, তাহা কোনক্রমেই ব্যর্থ হইবে না, তবে অধুনা এইমাত্র অনুগ্রহ করিতে পারি যে, তুমি শূদ্ৰযোনিসম্ভূত হইয়া পরমধার্ম্মিক হইবে এবং অবিচলিত ভক্তিসহকারে পিতামাতার শুশ্রূষা করিবে। সেই শুশ্রূষাফলে তোমার সিদ্ধি ও মহত্ত্ব লাভ হইবে এবং তুমি জাতিস্মর [যাহার পূর্ব্বজন্মবৃত্তান্ত স্মরণ থাকে] হইয়া স্বর্গে গমন করিবে। অনন্তর পাপক্ষয় হইলে তুমি পুনরায় ব্রাহ্মণকুলে সমুৎপন্ন হইবে।”
“উগ্ৰতেজাঃ মহর্ষি প্রথমতঃ অতি কঠোর শাপ প্ৰদান করিয়া পরিশেষে আমার প্রতি এইরূপ অনুগ্রহ প্ৰকাশ করিলেন। আমি তাঁহার শরীর হইতে শর উদ্ধৃত করিয়া তাঁহাকে লইয়া আশ্রমে গমন করিলাম; কিন্তু ভাগ্যক্রমে শরাঘাতে তাঁহার প্রাণবিয়োগ হয় নাই। হে দ্বিজোত্তম! আমার পূর্ব্ববৃত্তান্ত সমস্ত কীর্ত্তন করিলাম; আমি মুনিবচনপ্রভাবে ও পিতৃভক্তিবলে স্বৰ্গলাভ করিতে পারিব, সন্দেহ নাই।”
‘ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে মহামতে! মনুষ্য এইরূপে সুখ-দুঃখ প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে; অতএব উৎকণ্ঠিত হওয়া সর্ব্বতোভাবে অনুচিত। তুমি পূর্ব্বে আপনার জাতি জানিয়াও মৃগয়ারূপ দুষ্কর কর্ম্ম করিয়াছিলেন; এই নিমিত্ত আত্মকৃত কর্ম্মদোষজনিত ক্লেশ কিঞ্চিৎকাল ভোগ কর, পরে পবিত্ৰ দ্বিজকুলে সমুৎপন্ন হইবে, সন্দেহ নাই। সম্প্রতি তোমাকে ব্রাহ্মণ বলিয়া আমার বোধ হইতেছে। পাতিত্যজনক-কুক্ৰিয়াসক্ত, দাম্ভিক ব্রাহ্মণ প্রাজ্ঞ হইলেও শূদ্রসদৃশ হয়, আর যে শূদ্র সত্য, দাম ও ধর্ম্মে সতত অনুরক্ত তাহাকে আমি ব্রাহ্মণ বিবেচনা করি, কারণ, ব্যবহারেই ব্রাহ্মণ হয়। মনুষ্যেরা কর্ম্মদোষবশতঃ দুৰ্গতি লাভ করিয়া থাকে, কিন্তু তোমার উভয়বিধ কাৰ্য্যেই অতি সামান্য দোষ দৃষ্ট হইতেছে, অতএব প্রগাঢ় উৎকণ্ঠা দূরীকৃত কর। লোকব্যবহারঙ্গ ধর্ম্মপরায়ণ ভবাদৃশ ব্যক্তিরা কখন বিষাদসাগরে নিমগ্ন হয়েন না।”
“ব্যাধ কহিল, “হে দ্বিজোত্তম! জ্ঞানদ্বারা মানসিক দুঃখ ও ঔষধদ্বারা শারীরিক দুঃখ নিবারিত হয়, এই জ্ঞান স্থবির-ব্যক্তির ন্যায় বালকদিগের অন্তঃকরণে সমুদিত হয় না। অল্পবুদ্ধি মনুষ্যেরাই ইষ্টবিয়োগ ও অনিষ্টসংযোগে দুঃখিত হয়। সকল ভুতই সুখ, দুঃখ ও মোহে সংযুক্ত এবং বিমুক্ত হইয়া থাকে; অতএব তন্নিমিত্ত শোক করা নিতান্ত অনুচিত।
‘লোকে অনিষ্টপাত দর্শনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়, কিন্তু যদি উপক্ৰমে [প্রারম্ভে—প্ৰথম অবস্থাতেই] অবগত হইতে পারে, তাহা হইলে অনিষ্টপাতের প্ৰতিকার চেষ্টা করে। আর শোক করিলে কেবল পরিতাপ ভিন্ন আর কিছুই লাভ হয় না। যাহারা সুখ-দুঃখ উভয়ই পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয়েন, সেই জ্ঞানতৃপ্ত মনীষী মহাপুরুষেরাই যথার্থ সুখী।
‘অসন্তোষ অতি হেয় পদার্থ উহার অন্ত নাই, মূঢ় লোকেরাই নিরন্তর সেই অসন্তোষের পরবশ হইয়া থাকে, কিন্তু পণ্ডিতগণের চিত্তক্ষেত্রে অশেষ সুখনিদান সন্তোষ বদ্ধমূল হইয়া সর্ব্বদা বাস করে, তাঁহারা দুৰ্গতিপ্রাপ্ত হইলেও কখন শোকাভিভূত হয়েন না। জ্ঞানী ব্যক্তির বিষণ্ন হওয়াও কোনক্রমে উচিত নহে; কারণ, বিষাদ তীব্রতর বিষম্বরূপ। যেমন ক্রোধান্ধ ভুজঙ্গ বালককে দংশন করে, তদ্রূপ বিষাদ নির্বোধ ব্যক্তির প্রাণসংহার করে। বিষাদ বিক্ৰমসময়ে যাহাকে অভিভূত করে, সে তেজোবিহীন, সুতরাং তাহার পৌরুষ থাকে না।
‘কর্ম্ম করিলে অবশ্যই তাহার ফলভোগ করিতে হয়, অতএব দুঃখ উপস্থিত হইয়াছে বলিয়া ঔদাস্য করা অবিধেয়; কেন না, অন্তঃকরণে নির্ব্বেদ উপস্থিত হইলে কিছুমাত্র প্রতিভা থাকে না, অতএব দুঃখ হইতে বিমুক্ত হইবার উপায় উদ্ভাবন করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। শোকরহিত হইয়া কাৰ্য্য করিলে কদাচ দুঃখ বা বিপদ উপস্থিত হয় না। যে প্রাজ্ঞ পুরুষেরা জীবের বিনশ্বরত্ব চিন্তা করিয়া জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা প্ৰাপ্ত হয়েন, তাহারা কদাচ শোকাভিভূত হয়েন না, প্রত্যুত সদগতি লাভ করেন।
‘হে বিদ্বন! আমি এই সমস্ত পৰ্য্যালোচনা করিয়া বিষণ্ন বা শোকাভিভূত হই না, বরং অবিচলিতচিত্তে কালের প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছি।”
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে ধর্ম্মব্যাধ! তুমি অসামান্য ধীশক্তিসম্পন্ন, মেধাবী, ধর্ম্মজ্ঞ ও জ্ঞানে পরিতৃপ্ত হইয়াছ, অতএব তোমার নিমিত্ত উদ্বিগ্ন হইবার আবশ্যক নাই, এক্ষণে বিদায় হই; তোমার মঙ্গল হউক, ধর্ম্ম তোমাকে রক্ষা করুন; তুমি সর্ব্বদা অপ্ৰমত্ত হইয়া ধর্ম্মচিন্তা করিবে।’ ব্যাধ কৃতাঞ্জলিপুট “যে আজ্ঞা” বলিয়া ব্রাহ্মণকে বিদায় করিলে পর তিনি তাহাকে প্ৰদক্ষিণপূর্ব্বক স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।
“অনন্তর ব্রাহ্মণ গৃহে উপস্থিত হইয়া যথান্যায়ে দৃঢ়তর ভক্তিসহকারে পিতামাতার শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। হে ধার্ম্মিকাগ্রগণ্য যুধিষ্ঠির! তুমি ধর্ম্মবিষয়ে যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন এবং ধর্ম্মব্যাধ যে পতিব্ৰতা ও ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য এবং জনক-জননীর শুশ্ৰষা কীর্ত্তন করিয়াছেন, তৎসমুদয় বর্ণন করিলাম।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ধর্ম্মবিদাংবর! আপনি যে অদ্ভুত অনুত্তম ধর্ম্মাখ্যান কীর্ত্তন করিলেন, ইহা পরামপ্রীতিকর ও শ্রুতিসুখাবহ বলিয়া এই দীর্ঘকাল মুহুর্তের ন্যায় অতিবাহিত হইল; আমি ধর্ম্মাখ্যান-শ্রবণে অদ্যাপি পরিতৃপ্ত হই নাই।”