২১৪তম অধ্যায়
কৌশিকের প্রতি পিতৃমাতৃসেবার্থ ধর্ম্মব্যাধের উপদেশ
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, ‘ধর্ম্মব্যাধ এইরূপে ব্ৰাহ্মণ সমীপে স্বীয় মাতাপিতার বৃত্তান্ত নিবেদনানন্তর পুনরায় কহিতে লাগিল, ‘হে ব্ৰহ্মন! যে নিমিত্ত সেই সত্যশীলা পতিপরায়ণা কামিনী “হে বিপ্র! আপনি মিথিলায় গমন করুন, তত্ৰত্য ব্যাধ আপনাকে ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিবে” এই কথা বলিয়া আপনাকে এই স্থানে প্রেরণ করিয়াছেন, আমি দিব্যচক্ষু ও তপোবলপ্রভাবে তাহা বুঝিতে পারিয়াছি।”
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে যতব্ৰত! সুশীলা পতিব্ৰতা তোমাকে যে পরমধর্ম্মজ্ঞ ও গুণবান বলিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা আমি প্রত্যক্ষ করিলাম।”
“ব্যাধ কহিল, “হে বিপ্রবর! সেই পতিব্ৰতা আমার বৃত্তান্ত সম্যকরূপে জানিতে পারিয়াই আপনাকে আমার নিকট উপস্থিত হইতে কহিয়াছেন। আমি আপনার হিতসাধনার্থই আপনাকে এই সমস্ত প্ৰদৰ্শন করিলাম, এক্ষণে হিতোপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ করুন।
“আপনি পিতামাতার অনুমতি না লইয়াই তাঁহাদিগকে পরিত্যাগপূর্ব্বক বেদাধ্যায়নার্থ গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া নিতান্ত অন্যায় কাৰ্য্য করিয়াছেন। সেই বৃদ্ধ জনক-জননী আপনার শোকে অন্ধ হইয়াছেন; অতএব আপনি তাহাদিগকে প্ৰসন্ন করিবার নিমিত্ত শীঘ্ৰ গমন করুন। আপনি তপস্বী, মহাত্মা ও ধর্ম্মনিরত, অতএব আপনি শীঘ্র পিতামাতাকে প্ৰসন্ন করিতে গৃহাভিমুখে গমন করুন, নতুবা আপনার সমুদয় ধর্ম্মকর্ম্মই ব্যর্থ হইবে। হে ব্ৰহ্মন! আমি আপনাকে সদুপদেশ প্রদান করিতেছি, আপনি আমার বাক্যে শ্রদ্ধা করিয়া সত্বর জনক-জননীসন্নিধানে গমন করুন।”
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে ধর্ম্মাত্মন! তুমি যাহা কহিলে, তৎসমুদয়ই যথার্থ, তাহাতে সন্দেহ নাই; অতএব আমি তোমার প্রতি পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি।”
“ব্যাধ কহিল, “হে ব্ৰহ্মন! আপনি প্রাকৃত জনগণের দুষ্প্রাপ্য সনাতন কর্ম্মের অনুষ্ঠানদ্বারা দেবপ্রতিম হইয়াছেন; অতএব স্বীয় পিতামাতার সমীপে গমনপূর্ব্বক অপ্ৰমত্তচিত্তে তাঁহাদের পূজা করুন। আমার মতে উহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কর্ম্ম আর কিছুই নাই।”
“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! আমি ভাগ্যবলেই এখানে আসিয়াছি ও ভাগ্যবলেই তোমার সাক্ষাৎকার লাভ করিয়াছি। হে ধর্ম্মাত্মন! তোমার ন্যায় ধর্ম্মোপদেষ্টা ব্যক্তি নিতান্ত দুর্লভ, কেন না, এই জগতীতলে সহস্রের মধ্যে একজন ধর্ম্মজ্ঞ হয়েন কি না সন্দেহ। হে মহাত্মন! অদ্য আমি তোমার সত্যাচার-সন্দর্শনে পরামপ্রীত হইলাম। আমি নরকে নিপতিত হইতেছিলাম, তুমিই অদ্য আমাকে সমুদ্ধৃত করিলে। অদ্য ভবিতব্যতাপ্রভাবে তোমার সন্দর্শন প্রাপ্ত হইয়াছি। যেমন ভৌম নরকে পতনোন্মুখ রাজা যযাতির সাদাত্মা স্বীয় দৌহিত্ৰগণের অনুগ্রহে সন্তারিত হইয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি আজি আমাকে রক্ষা করিলে।
‘হে পুরুষাগ্রগণ্য! আমি তোমার বচনানুসারে অদ্যাবধি সংযতচিত্তে পিতামাতার শুশ্রূষা করিব। মূঢ়ব্যক্তি কখনই ধর্ম্মাধর্ম্ম নির্ণয় করিতে বা উহার উপদেশ দিতে পারে না, আর সনাতন ধর্ম্ম শূদ্ৰজাতির নিতান্ত দুর্জ্ঞেয়, অতএব স্পষ্ট বোধ হইতেছে যে, তোমার শূদ্রতাপ্রাপ্তি-বিষয়ে অবশ্যই কোন গৃঢ় কারণ আছে। হে মহামতে! আমি যথার্থরুপে এই বিষয় জানিতে বাসনা করি, তুমি অনুগ্রহ করিয়া কীর্ত্তন কর।”
ধর্ম্মব্যাধের পূর্ব্বজন্ম—ঋষিশাপ
“ব্যাধ কহিল, “হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! আমার মতে ব্ৰাহ্মণগণের বাক্য অতিক্রম করা নিতান্ত অনুচিত, অতএব আমার পূর্ব্বজন্মের বৃত্তান্ত কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। আমি পূর্ব্বজন্মে বেদ-বেদাঙ্গপারগ ব্রাহ্মণ ছিলাম, আপনার দোষেই এই দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়াছি। হে দ্বিজবর! পূৰ্ব্বজন্মে এক ধনুৰ্বেদপরায়ণ ভূপতি আমার সখা ছিলেন। তাঁহার সহিত সতত সহবাস হওয়াতে আমিও ক্রমে ক্রমে একজন ধনুৰ্দ্ধর হইয়া উঠিলাম। একদা ঐ ভূপতি প্রধান প্রধান যোদ্ধা ও মন্ত্রিগণ-সমভিব্যাহারে মৃগয়াভিলাষী হইয়া এক তপোবনে গমন করিলেন। আমিও তাঁহার সহিত মৃগয়ায় গমন করিলাম। দৈবের কি অখণ্ডনীয় প্রভাব! আমি তীক্ষ্ণ শরনিকরদ্ধারা মৃগগণের প্রাণসংহার করিতেছিলাম, এমত সময়ে দৈবাৎ এক বাণ মহর্ষির গাত্রে নিপতিত হইল।
‘হে দ্বিজবর! মহর্ষি বাণাঘাতে একান্ত ব্যথিত ও ধরাতালে নিপতিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, “হায়! আমি কাহারও কোনও অপকার করি নাই; তবে কে এমন পপকর্ম্ম করিল?” আমি ঐ সময়ে শরদ্বারা মৃগ বিদ্ধ করিয়াছি বিবেচনা করিয়া সহসা তথায় গমনপূর্ব্বক দেখিলাম, বাণদ্বারা ঋষিকে বিদ্ধ করিয়াছি। হে ব্ৰহ্মন! মহৰ্ষিকে ক্ষিতিতলে বিলুণ্ঠমান অবলোকনপূর্ব্বক আপনার অকাৰ্য্য স্মরণ করিয়া নিতান্ত ব্যথিতচিত্ত হইলাম। পরে বিনয়-বচনে মহর্ষিকে কহিলাম, “হে ব্ৰহ্মন! আমি অজ্ঞাতসারে এই কুকর্ম্ম করিয়াছি; অতএব আমার অপরাধ মার্জ্জন করুন।” মহর্ষি আমার বাক্যে অনাস্থা প্রদর্শনপূর্ব্বক রোষকষায়িতলোচনে আমাকে কহিলেন, “অরে ক্রূর! তুই ব্যাধ হইয়া শূদ্ৰযোনিতে জন্মগ্রহণ করিবি।”