২১৩তম অধ্যায়
ধর্ম্মব্যাধের মাতৃপিতৃপূজা-প্রকাশ
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! ধর্ম্মব্যাধ এইরূপে সমুদয় মোক্ষধর্ম্ম কহিলে পর, ব্ৰাহ্মণ প্রীত হইয়া তাহাকে কহিলেন, “হে ধর্ম্মাত্মন! তুমি যাহা যাহা কহিলে, তৎসমুদয়ই ন্যায়ানুগত। ধর্ম্মবিষয়ে তোমার কিছুই অবিদিত নাই।”
“ব্যাধ কহিল, “হে দ্বিজোত্তম! আমি যে ধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া এই সিদ্ধিলাভ করিয়াছি, আপনি তাহা একবার প্রত্যক্ষ অবলোকন করুন, আর আপনি শীঘ্ৰ গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক ভবনাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া আমার পিতামাতাকে দর্শন করুন।”
“ব্রাহ্মণ ব্যাধের বাক্যনুসারে তাহার সহিত সেই পরমরমণীয় চতুঃশাল সৌধমধ্যে প্রবেশ করিলেন। ঐ সৌধ সুরসদনসদৃশ, দেবগণপূজিত, নানাবিধ আসন ও শয়নীয়ে ব্যাপ্ত এবং পরমোৎকৃষ্ট গন্ধদ্রব্য-সমুদয়ে সমাকীর্ণ। ব্রাহ্মণ তন্মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক দেখিলেন যে, ব্যাধের বৃদ্ধ পিতা ও মাতা শুক্লাম্বর পরিধান ও উত্তমরূপ আহার করিয়া পরম পরিতুষ্টচিত্তে উৎকৃষ্ট আসনে উপবিষ্ট রহিয়াছে।
“ধর্ম্মব্যাধ স্বীয় পিতামাতাকে অবলোকন করিবামাত্ৰ তাহাদিগের পদতলে নিপতিত হইল। বৃদ্ধ-দম্পতি নিজ তনয়কে চরণতলে নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া কহিতে লাগিল, “বৎস! গাত্ৰোত্থান কর, ধর্ম্ম তোমাকে রক্ষা করুন, আমরা তোমার শৌচসন্দর্শনে পরমপ্রীত হইয়াছি, অতএব তুমি দীর্ঘায়ু হও। তুমি হৃষ্টগতি, জ্ঞান ও মেধা প্রাপ্ত হইয়াছ, তুমি আমাদের সৎপুত্ৰ, প্রত্যহই যথাকলে উত্তমরূপে আমাদিগকে পূজা করিয়া থাক ও দেবতা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কর। তুমি দ্বিজাতিগণের প্রতি সতত প্ৰযতচিত্ত ও একান্ত দান্ত হইয়াছ; অতএব হে পুত্র! আমার পূর্ব্বপিতামহগণ তোমার দম ও পিতৃপূজন-সন্দর্শনে তোমার প্রতি পরম পরিতুষ্ট রহিয়াছেন। তুমি কায়মনোবাক্যে আমাদের শুশ্রূষা করিতে অণুমাত্র ত্রুটি কর না। ফলতঃ তোমার মনে কেবল আমাদের প্রতিই সতত অনুরক্ত রহিয়াছে। হে বৎস! জমদগ্নিনন্দন পরশুরাম যেমন স্বীয় বৃদ্ধ পিতামাতার সেবা করিয়াছিলেন, তুমিও তদ্রূপ আমাদের শুশ্রূষা করিতেছ।”
“বৃদ্ধ-দম্পতির বাক্যাবসানে ধর্ম্মব্যাধ গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক সেই ব্ৰাহ্মণের বিষয় তাহাদের নিকট নিবেদন করিল। তখন তাহারা সেই ব্ৰাহ্মণকে স্বাগত-প্রশ্নপূর্ব্বক যথাবিধি পূজা করিলে ব্রাহ্মণও প্ৰতিপূজনপূর্ব্বক তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে বৃদ্ধদম্পতি! তোমাদের পুত্র ও ভৃত্যগণ এবং স্বীয় শরীরের ত’ মঙ্গল?” বৃদ্ধদ্বয় কহিল, “হে মহাত্মন! আমাদের সমুদয় মঙ্গল। আপনি ত’ নির্ব্বিঘ্নে আগমন করিয়াছেন?” ব্ৰাহ্মণ হৃষ্টচিত্তে কহিলেন, হাঁ, নির্ব্বিঘ্নেই আগমন করিয়াছি।”
“তখন ধর্ম্মব্যাধ ব্ৰাহ্মণের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক কহিতে লাগিল, “হে ভগবান! ইঁহারা আমার পিতামাতা, আমি ইহাদিগকে দেবতার তুল্য বিবেচনা করি; দেবগণের উদ্দেশে যাহা যাহা করিতে হয়, তৎসমুদয় ইহাদের সমীপেই সম্পন্ন করিয়া থাকি। যেমন ইন্দ্রাদি দেবগণ সর্ব্বলোকের পূজনীয়, তদ্রূপ এই বৃদ্ধদম্পতি আমার অর্চনীয়। ব্রাহ্মণগণ যেমন দেবগণের নিমিত্ত উপহার আহরণ করেন, আমিও ইহাদের নিমিত্ত তদ্রূপ উপহার। আহরণ করিয়া থাকি। এই পিতামাতা আমার পরামদেবতাস্বরূপ, আমি ইহাদিগকে নানাবিধ পুষ্প, ফল ও রত্নদ্বারা সতত পরিতুষ্ট করি। আমি এই দুইজনকে অগ্নি, যজ্ঞ ও চারি বেদের ন্যায় জ্ঞান করি। হে ব্ৰহ্মন! আমার ভাৰ্য্যা, পুত্র, সুহৃজন ও প্রাণ এই সমুদয় ইহাদিগের সেবার নিমিত্ত আছে। আমি পুত্ৰকলাত্ৰ-সমভিব্যাহারে সতত ইঁহাদিগের শুশ্রূষা করি।
‘হে দ্বিজসত্তম! আমি স্বয়ং ইহাদিগকে স্নান করাইয়া পাদপ্রক্ষালনপূর্ব্বক স্বহস্তে আহার প্রদান করি। সতত ইঁহাদের অনুকুল বাক্য প্রয়োগ করি, বিপ্রিয় [অপ্রীতিকর] বাক্য কদাচ আমার মুখ হইতে বিনিৰ্গত হয় না। অধিক কি, ইহাদের প্রিয়কর্ম্মানুষ্ঠানের নিমিত্ত যদি অধর্ম্মাচরণ করিতে হয়, তথাপি আমি তাহাতে পরাঙ্মুখ হই না।
“হে দ্বিজসত্তম! আমি পিতামাতাকে ধর্ম্মস্বরূপ জ্ঞান করিয়া আলস্য পরিত্যাগপূর্ব্বক অনন্যমনে সতত তাহাদিগের শুশ্রূষা সম্পাদনা করিয়া থাকি। পিতা, মাতা, অগ্নি, আত্মা ও উপদেষ্টা এই পাঁচজন গুরু। এই পাঁচজনের প্রতি সম্যকরূপে সদ্ব্যবহার করিলে প্রত্যহ অগ্নিসেবা সম্পন্ন হয়। হে বিপেন্দ্ৰ! গৃহস্থ ব্যক্তির এইরূপ নিত্যধর্ম্ম প্রতিপালন করা অবশ্য কর্ত্তব্য।’