২১২. সুন্দ-উপসুন্দসমীপে তিলোত্তমার আগমন, দ্বন্দ্বযুদ্ধে সুন্দ-উপসুন্দের সংহার
দ্বাদশাধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
নারদ কহিলেন,—এদিকে দানবরাজ সুন্দ ও উপন্দ স্বীয় বাহুবলে ত্রিভুবনবিজয়কার্যে কৃতকাৰ্য হইয়া নিষ্কণ্টক হইল। দেব, গন্ধর্ব, যক্ষ, নাগ, রাক্ষস ও ভূপতিগণের সমস্ত রত্নজাত অপহরণপূর্বক পরমাল্লাদে কালাতিপাত করিতে আরম্ভ করিল। তাহারা যখন দেখিল যে, ত্রিলোকমধ্যে কেহই, তাহাদের প্রতিদ্বন্দী নাই, তখন একবারে যুদ্ধাদি চেষ্টা পরিত্যাগপূর্বক কেবল উত্তমোম স্ত্রী, মাল্য, গন্ধ, ভক্ষ্য ও পানীয় প্রভৃতি বিবিধ মনোহর উপভোগ্য বস্তু ভোগ করিয়া অমরের ন্যায় কখন অন্তঃপুরোদ্যানে, কখন পর্বতে,কখন কনে, কখন বা অন্যান্য অভিলষিত স্থানে বিহার করিতে লাগিল।
একদা ঐ দানবদ্বয় বিহারার্থ সমশিলাতলসম্পন্ন ও নানাবিধ সুগন্ধি পুষ্পে সুশোভিত পাদপপুঞ্জে পরিপূর্ণ বিন্ধ্যপর্বতের প্রদেশে গমন করিল; পরিচারকগণ তথায় সর্বপ্রকার ভোগ্যবস্তু প্রস্তত করিয়া রাখিয়াছে। তখন সুন্দ উপসুদ সন্তুষ্টচিতে কামিনীগণ সমভিব্যাহারে মহামূল্য আসনে উপবিষ্ট হইল এবং রমণীগণ নৃত্য, গীত, বাদ্য ও স্তুতিবাখারা তাহাদিগকে আহ্লাদিত করিতে লাগিল। ঐ সময়ে বরবর্ণিনী তিলোত্তমা সূক্ষ রক্তাক্ষর পরিধান ও মনোহারিণী বেশভূষা ধারণপূর্বক ঐ পৰ্বতস্থ কাননে পুষ্প চয়ন করিতে আরম্ভ করিল। সে নদীতীরজাত কণিকারসকল চয়ন করিয়া অল্পে অল্পে মুন্দোপসুন্দ সমীপে সমুপস্থিত হইল; দানবদ্বয় তৎকালে সুরাপানে মত্ত হইয়াছিল; চারুহাসিনী তিলোত্তমা তাহাদের নয়নগোচর হইবামাত্র উভয়েই এককালে কন্দর্পশরে জর্জরিত হইল। তখন তাহারা দুই জুনেই তিলোত্তমা গ্ৰহণাভিলাষে আসন হইতে গত্রোত্থানপূর্বক তাহার নিকট গমন করিয়া, সুন্দ তাহার দক্ষিণ কর ও উপন্দ বাম কর ধারণ করিল। বরপ্রদান-মদ, ধনমদ, কলমদ এবং সুরাপান-মদ প্রভৃতি নানা মদে মত এবং কন্দর্পশরে জর্জরিত সেই দানবদ্বয় ভ্রুকুটিবন্ধনপূর্বক পরস্পর পরস্পরকে কহিতে লাগিল। সুন্দ কহিল, এ আমার ভাৰ্যা, সুতরাং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পত্নী বলিয়া তোমার গুরু হইল। উপন্দ কহিল, এ আমার ভাৰ্য্যা, সুতরাং কনিষ্ঠ ভ্রাতার পত্নী বলিয়া তোমার বধু হইল। এইরূপে “এ আমার ভাৰ্য্যা তোমার নয়, আমার ভাৰ্য্যা তোমার নয়,” এই কথা বারংবার কহিতে কহিতে তাহার কামে মোহিত হইয়া চিরপরিচিত সৌভ্রাত্র ও সৌহার্দে এককালে জলাঞ্জলি প্রদানপূর্বক ক্রোধভরে উভয়ে ভয়ঙ্কর গদা প্ৰহণ করিল এবং আমি পূর্বে বধ করিব, আমি পূর্বে বধ করিব বলিয়া পরস্পর পরস্পরকে প্রচণ্ড আঘাত করিতে করিতে রুধিরাক্তকলেবর হইয়া গগনচ্যুত সূৰ্য্যদ্বয়ের ন্যায় দুই জনেই ভূতলে পতিত ও পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। তখন সেই মহাবীরমুগলকে ভূতলশায়ী দেখিয়া তত্র রমণীগণ ও দানব সমুদায় ভয়ে কম্পিকলেবর হইয়া পাতালতলে পলায়ন করিল।
তদনন্তর সর্বলোক-পিতামহ ভগবান্ ব্ৰহ্মা, দেবগণ ও মহর্ষিগণ সমভিব্যাহারে তিলোত্তমা সমীপে আগমনপূর্বক তাহাকে ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। বিধাতা হৃষ্টচিত্ত হইয়া তাহাকে বর প্রদান করিবার মানসে কহিলেন, হে ভাবিনি! সূৰ্য্য যে পথে গতায়াত করেন, তুমি সেই পথে গমনাগমন করিবে, তেজঃধভাবে কেহই তোমাকে স্পষ্ট দেখিতে পাইবে না। ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে এইরূপ বর প্রদানানন্তর ইন্দ্রহন্তে ত্রৈলোক্যরক্ষার ভারার্পণপূর্বক ব্ৰহ্মলোকে প্রস্থান করিলেন।
হে পাণ্ডবগণ! পূৰ্বকালের সুন্দ ও উপসুন্দ এইরূপে বাল্যকালাবধি একনিশ্চয় থাকিয়াও কেবল তিলোমার নিমিত্তই উভয়ে বিবাদ করত পরস্পর পরস্পরকে সংহার করিয়াছিল। অতএব আমি তোমাদের প্রতি একান্ত স্নেহবান হইয়া উপদেশ দিতেছি যে, যাহাতে দ্রৌপদীর নিমিত্ত তোমাদের পরম্পর ভেদ না হয়, এমত কাৰ্য্য কর; তাহা হইলে আমি পরম প্রীত হইব!
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহাত্মা পাণ্ডুনন্দনগণ মহর্ষি নারদের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহার সমক্ষে পরস্পর এই নিয়ম করিলেন যে, আমাদের পাঁচ জনের মধ্যে এক জন যখন দ্রৌপদীর নিকটে থাকিবে, তখন অন্য জন তথায় যাইতে পারিবে না। যে এই নিয়ম উল্লঙ্ঘন করিবে, তাহাকে ব্রহ্মচারী হইয়া দ্বাদশ বৎসর বনে বাস করিতে হইবে। ধর্মাত্মা পাণ্ডবগণ এইরূপ নিয়ম করিলে, তপোধন নারদ পরম প্রীত হইয়া স্বাভিলষিত স্থানে প্রস্থান করিলেন। হে ভরতবংশাবতংস জনমেজয়! পাণ্ডুতনয়গণ এইরূপে নারদের উপদেশানুসারে নিয়ম করিয়াছিলেন; তমিমিই তাঁহাদের পরস্পর প্রণয় ভঙ্গ হয় নাই।
রাজ্যলাভ পর্বাধ্যায় সমাপ্ত।