২১১তম অধ্যায়
দেহচক্র—জীবাত্মার আবর্ত্তন-নিবর্ত্তন
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! এই জগতে স্থাবরজঙ্গমাত্মক চতুৰ্ব্বিধ প্রাণী বিদ্যমান রহিয়াছে। ইহাদিগের জন্ম ও মৃত্যু স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় না। মন অব্যক্ত আত্মার স্বরূপ, সুতরাং উহাও অব্যক্ত। যেমন কণামাত্র বীজ হইতে প্রকাণ্ড অশ্বত্থ বৃক্ষের আবির্ভাব হয়, তদ্রূপ অব্যক্ত হইতে সমুদয় সম্ভূত হইয়া থাকে। অচেতন অয়স্কান্ত মণি যেমন: লৌহপিণ্ডের এবং প্রাক্তন কৰ্ম্মজনিত ধৰ্ম্মাধর্ম্ম যেমন দেহীর অভিমুখে ধাবমান হয়, তদ্রূপ অবিদ্যাজনিত কামাদি ইন্দ্রিয়বৃত্তি ও চিত্তানন্দ প্রভৃতি ভাবসমুদয় মিলিত হইয়া দেহান্তরে শরীরীকে আশ্রয় করে। পূৰ্ব্বে ভূমি, আকাশ, স্বর্গ, মহাভূত প্রাণ এবং শান্তি ও কামাদি গুণসমুদয় কিছুই বিদ্যমান ছিল না; একমাত্র জীবেরই সত্তা ছিল। বস্তুতঃ জীবের সহিত পৃথিব্যাদির কোন সম্পর্ক নাই। আপাততঃ জীবের সহিত পৃথিব্যাদির যে সম্বন্ধ বোধগম্য হয়, মায়াই তাহার কারণ। জীব সৰ্ব্বব্যাপী, অনির্ব্বচনীয় ও নিত্য। উহা পূর্ব্বন বাসনাপ্রভাবেই আপনাকে মনুষ্য, পশু বা অন্য কোন জন্তু বলিয়া বিবেচনা করে; এই বাসনাবশতঃই জীব কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয় এবং কৰ্ম্মবশতঃই তাহার বাসনা উৎপন্ন হয়। এইরূপে জীবের কর্ম্ম ও বাসনা চক্রের ন্যায় পরিভ্রমণ করিতেছে। জন্মমরণপ্রবাহরূপ চক্র নিরন্তর পরিবর্তিত হইতেছে। বুদ্ধি ও বাসনা ঐ চক্রের নাভি, দেহ ও ইন্দ্রিয়াদি উহার অর [চাকা], জ্ঞানক্রিয়াদি উহার নেমি [চক্ৰপরিধি-চক্রের প্রান্ত, বেড়], রজোগুণ উহার অক্ষ [চক্রের মধ্যমণ্ডল] এবং আত্মা উহার অধিষ্ঠাতা। তৈলিকেরা যেমন তিল নিপীড়ন করে, তদ্রূপ অজ্ঞানসম্ভূত সুখদুঃখভোগ ঐ চক্রে এই জগৎ নিপীড়িত করিতেছে। সকলেই ফললাভবাসনায় অহঙ্কারে আক্রান্ত হইয়া কৰ্ম্মানুষ্ঠান করে। বাসনাই কাৰ্য্যকারণ সংযোগের হেতু বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়া থাকে। কাৰ্য্য ও কারণ অভিন্ন পদার্থ; কার্য্য কারণকে বা কারণ কাৰ্য্যকে কখনই অতিক্রম করে না। কাল কাৰ্য্যসাধনের প্রধান হেতু। প্রকৃতি ও বিকৃতি ইহারা পুরুষকে আশ্রয়পূৰ্ব্বক কর্ম্মসংযুক্ত হইয়া পরস্পর মিলিত থাকে। ধূলি যেমন সমীরণকর্ত্তৃক সঞ্চালিত হইয়া উহার অনুগমন করে, তদ্রূপ জীবাত্মা দেহ-পরিভ্রষ্ট হইবামাত্র রাজসিক ও তামসিক ভাব এবং পূৰ্ব্বকৃত কৰ্ম্ম ও বিদ্যাবলসংযুক্ত হইয়া পরমাত্মাকে লক্ষ্য করিয়া তাঁহার অনুগমনে [অধীনতাবশে অনুকরণে] প্রবৃত্ত হয়। আর বায়ু যেমন ধূলিসঞ্চালন করিয়াও উহার সহিত নির্লিপ্ত থাকে, তদ্রূপ আত্মা রাজসিকাদি ভাবের সহিত সংযুক্ত হইয়াও তাহাতে লিপ্ত হয় না। এইরূপে পণ্ডিতগণ বায়ুর সহিত ধূলির ন্যায়, সত্ত্বাদিগুণের সহিত জীবাত্মার পৃথগভাব অবগত হইবেন; হে ধৰ্ম্মরাজ! শিষ্যের সন্দেহ উপস্থিত হইলে, ভগবান্ ঋষি এইরূপে উহা ভঞ্জন করিয়াছিলেন। সুখদুঃখপরিহারের উপায় পর্য্যালোচনা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। বীজ সকল যেমন অনল দগ্ধ হইলে আর পুনরায় অঙ্কুরিত হয় না, তদ্রূপ ক্লেশসমুদয় জ্ঞানাগ্নিতে দগ্ধ হইলে আর জীবাত্মাতে আবির্ভূত হইতে পারে না।”