শমন-দমন রাবণ রাজা রাবণ দমন রাম।
শমন-ভবন না হয় গমন যে লয় রামের নাম।।
চণ্ডালে যাঁহার দয়া বড় সকরুণ।
পাষাণে নিশান আছে শ্রীরামের গুণ।।
শ্রীরাম নামের গুণে কি দিব তুলনা।
পাষাণ মনুষ্য করে নৌকা করে সোনা।।
রামনাম লৈতে ভাই না করিহ হেলা।
সংসার তরিতে রামনামে বান্ধ ভেলা।।
শ্রীরাম স্মরিয়া যেবা মহারণ্যে যায়।
ধনুর্ব্বাণ লৈয়া রাম পশ্চাতে গোড়ায়।।
দক্ষিণে রাবণ বৈসে সুগ্রীব তা জানে।
বড় বড় বীর পাঁচে সেই ত দক্ষিণে।।
বালির কুমার পাঁচে মন্ত্রী জাম্বুবান।
পবননন্দন পাঁচে বীর হনুমান।।
ঋষভ কুমুদ পাঁচে রন্ধা যোদ্ধাপতি।
নল নীল পাঁচিলেক মুখ্য-সেনাপতি।।
সুগ্রীব বলেন, সৈন্য শুন সাবধানে।
সীতার উদ্দেশে যাহ তোমরা দক্ষিণে।।
যত নদ নদী দেখ, যত দেখ দেশ।
যত যত গিরি আছে, করিবে প্রবেশ।।
উত্তম অধম স্থানে করিহ প্রবেশ।
যেরূপে পাইতে পার সীতার উদ্দেশ।।
কৃষ্ণাবেণী নদী যে নর্ম্মদা গোদাবরী।
যাবে অশ্বমুখ গিরি নদী যে কাবেরী।।
পাইবা পর্ব্বত বিন্ধ্য সহস্র শিখর।
নানা ফল ফুল তথা দিব্য সরোবর।।
পরেতে কলিঙ্গদেশ যাইবে উৎকল।
মলয় পর্ব্বতে গিয়া দেখিবে সকল।।
মহেন্দ্র পর্ব্বতে যাবে অত্যুচ্চ শিখর।
সর্ব্বক্ষণ থাকেন তথায় পুরন্দর।।
তাহার দক্ষিণে যাইও সরোবর তীর।
চন্দনের বন তথা, সুগন্ধি সমীর।।
সুগন্ধি চন্দন নিরখিবে সারি সারি।
সাগরের পারে যাইও স্বর্ণ লঙ্কাপুরী।।
মৈনাক পর্ব্বত আছে সাগর-ভিতর।
সলিল হইতে উঠে সহস্র শিখর।।
সোণার পর্ব্বত দশদিকের প্রকাশ।
সহস্র শিখর উঠে যুড়িয়া আকাশ।।
পবনের পিতা সে সূর্য্যের হয় সখা।
যার পাপ থাকে, তারে নাহি দেয় দেখা।।
সাগরের মধ্যে আছে সিংহিকা রাক্ষসী।
বিষমা রাক্ষসী সেই সর্ব্বলোকে ঘুষি।।
বিষমা রাক্ষসী সেই ছায়া পাইলে ধরে।
বার শত জীব জন্তু গিলে একবারে।।
সত্তর যোজন তনু আড়ে পরিসর।
দুই শত যোজন দীর্ঘে উভে কলেবর।।
অর্দ্ধ তনু জলে থাকে, অর্দ্ধেক আকাশ।
তাই দেখি বীরগণ না পাইও ত্রাস।।
সকল বানর তথা হইও সাবধান।
এক লাফে সাগর লঙ্ঘিলে হবে ত্রাণ।।
সাগর তরিবে সবে শতেক যোজন।
সাগরের পারে লঙ্কা তথায় রাবণ।।
চারিদিকে সাগর, মধ্যেতে লঙ্কাগড়।
দেবগণের গতি নাই লঙ্কার নিয়ড়।।
খুঁজিবে লঙ্কার মধ্যে সীতা লঙ্কেশ্বর।
যত্ন পুরঃসরে তথা সকল বানর।।
তথা যদি উভয়ের না পাও উদ্দেশ।
বিন্ধ্যাগিরি মধ্যে গিয়া করিবে প্রবেশ।।
অন্বেষণ করিহ তথায় কপিগণ।
বিশ্বকর্ম্মাকৃত পুরী সোণার গঠন।।
অগস্ত্যের বাড়ী বিশ্বকর্ম্মার নির্ম্মিত।
নানা রত্ন নানা ধাতু পর্ব্বত ভূষিত।।
বীরগণ অন্বেষিহ শিখরে শিখর।
যত্ন করি দেখো তথা সীতা লঙ্কেশ্বর।।
তথা যদি তাহাদের না পাও দর্শন।
ঋষভ পর্ব্বতে যাইও সব বীরগণ।।
ঋষভ পর্ব্বতবর দেখিবে দক্ষিণে।
দশদিক আলো করে সোণার কিরণে।।
গন্ধর্ব্ব আছয়ে তথা স্বর্ণ পঞ্চ গড়।
অন্য কে যাইতে পারে তাহার নিয়ড়।।
আনিতে তথায় রত্ন যদি যত্ন হয়।
বিষম গন্ধর্ব্ব তথা, করিহ সে ভয়।।
ধনলোভ করণেতে হইবে অনর্থ।
তাহা না লইবে কেহ, শুনহ যথার্থ।।
বিষম দুরন্ত তারা, সেইক্ষণে মারে।
তে কারণে দ্বন্দ্ব যেন কেহ নাহি করে।।
সাবধানে উঠি তথা শিখরে শিখরে।
যত্ন করি অন্বেষিও দুষ্ট লঙ্কেশ্বরে।।
তথা যদি নাহি পাও তাহার উদ্দেশ।
যমের দক্ষিণ বাড়ী করিও প্রবেশ।।
জীয়ন্তে যমের বাড়ী কারো নাহি গতি।
যমের দক্ষিণে নাই চন্দ্র-সূর্য্য-দ্যুতি।।
যমের দক্ষিণ দিকে মহা অন্ধকার।
রাত্রি দিন নাহি তথা, সব একাকার।।
যমের দক্ষিণে নাহি আমার গোচর।
যমপুরী হইতে ফিরিবে বীরবর।।
যমপুরী যাইতে আসিতে একমাস।
মাসের অধিক হৈলে সবার বিনাশ।।
মাসেকের মধ্যে যেই বীর না আইসে।
সবংশে মরিবে সেই আপনার দোষে।।
আনিবে সীতার বার্ত্তা শীঘ্র যেই জন।
বাড়াব তাহারে আমি সব বন্ধুগণ।।
সীতারে দেখিয়া যে আসিবে এক মাসে।
সদা বদ্ধ হইয়া থাকিব তার পাশে।।
সুগ্রীব বলেন, শুন পবন-নন্দন।
তুমি সে সাধিবে কার্য্য, লয় মোর মন।।
অগ্নি জল নাহি মান, পবনের গতি।
তুমি সে দেখিবে সীতা, লয় মোর মতি।।
তোমার প্রসাদে আমি সত্যে হব পার।
তব যশ ঘুষিবেক সকল সংসার।।
তুমি যদি সীতা দেখ তবে আমি সুখী।
আর কে দেখিবে সীতা ইহা নাহি দেখি।।
সুগ্রীব রামের প্রতি বলিল বচন।
জানাইতে জানকীরে দেহ নিদর্শন।।
হনুমান সহ তাঁর নাহি পরিচয়।
কি জানি বানর দেখি যদি পান ভয়।।
শ্রীরাম বলেন, শুন সুগ্রীব সুহৃৎ।
অঙ্গুরী দিলাম আমি সীতার প্রতীত।।
দিলেন অঙ্গুরী রাম নিজ নিদর্শন।
হাত পাতি নিল তাহা পবন-নন্দন।।
বিদায় হইয়া বীর হনুমান নড়ে।
পতঙ্গ-শরীর যেন ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে।।
চলিল সকল ঠাট সুগ্রীব আদেশে।
দক্ষিণের পাঁচনি রচিল কৃত্তিবাসে।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিত মুরারি ওঝার নাতি।
যার কণ্ঠে সদা কেলি করেন ভারতী।।