ভীমাদির জরাসন্ধপুরাক্রমণ
বাসুদেব কহিলেন, “হে পার্থ। ঐ দেখ, বিবিধ পশুসমাকীর্ণ বাপীতড়াগাদিযুক্ত, সুরম্য হর্ম্যে অলস্কৃত, উপদ্রবশুন্য মগধরাজ্য শোভা পাইতেছে। ঐ দেখ, বৈহার, বরাহ, বৃষভ, ঋষিগিরি ও চৈত্যক নামে পাঁচটি পর্ব্বত রহিয়াছে। এই শীতলক্ৰমসুশোভিত, উন্নতশিখর পর্ব্বতসকল পরস্পর মিলিত হইয়া গিরিব্রজ রক্ষা করিতেছে। সুপুষ্পিত শাখাসমূদয়ে সুশোভিত, সুগন্ধযুক্ত, কামিজনপ্রিয়, মনোহর লোধ্রবনরাজী উহাদিগকে যেন গোপন করিয়া রাখিয়াছে। এই স্থানে শংসিতব্ৰত মহাত্মা গৌতম ঋষি ক্ষত্ৰিয়দিগের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশপূর্ব্বক কাক্ষীব প্রভৃতি পুত্ৰগণকে উৎপাদন করেন। হে অর্জ্জুন! এই নিমিত্ত পূর্ব্বে অঙ্গ, বঙ্গ প্রভৃতি মহাবল-পরাক্রান্ত মহীপতিগণ গৌতমের আশ্রমে আসিয়া মহোৎসব করিতেন। ঐ দেখ, গৌতমের আশ্রমসমীপে পরামরমণীয় অশ্বথ ও লোপ্ৰবনরাজী জন্মিয়াছে। ঐ দেখ, অৰ্ব্বুদ পর্ব্বত, শক্রবাপী ও প্ৰকাণ্ড পন্নগদ্বয় রহিয়াছে। ঐ স্থানে স্বস্তিক ও মণিনাগের আলয়। মনু মগধরাজ্য মেঘের অপরিহাৰ্য্য করিয়া গিয়াছেন এবং চণ্ডকৌশিক ও মণিমান জরাসন্ধকে যথেষ্ট অনুগ্রহ করিয়াছেন। দুরাত্মা জরাসন্ধ এইরূপে ঐ দুরাক্রম্য পুরের অধীশ্বর হইয়া আপনার কার্য্যসিদ্ধি-বিষয়ে স্থিরনিশ্চয় হইয়াছে। আমরা অদ্য তাহার দর্পচূৰ্ণ করিব।”
বৈশম্পায়ন কহিলেন, তদনন্তর বিপুলতেজাঃ কৃষ্ণ মহাবলপরাক্রান্ত ভীমার্জ্জুন-সমভিব্যাহারে মগধপুরে গমন করিলেন এবং হৃষ্টপুষ্টজন ও বর্ণচতুষ্টয়-সমাকীর্ণ মহোৎসবময়, নিতান্ত দুরাক্রম্য গিরিব্রজে সমুপস্থিত হইলেন। তৎপরে দ্বারদেশে গমন করিয়া বৃহদ্ৰথবংশীয় জনসমুদয় ও অন্যান্য নগরবাসিগণ কর্তৃক পূজ্যমান মগধরাজ্যের শোভাসম্পাদক নগরচৈত্যের সমীপে দ্রুতবেগে গমন করিলেন। মহারাজ বৃহদ্ৰথ মাংসাশী বৃষরূপধারী দৈত্যকে সংহার করিয়া তাহার চর্ম্ম দ্বারা তিনটি ভেরী প্ৰস্তুত করেন; ঐ ভেরীত্রয়ে একবার আঘাত করিলে একমাসব্যাপী গভীর ধ্বনি হইত। মহারাজ বৃহদ্ৰথ আপনার পুরে ঐ তিনটি ভেরী রাখিয়াছিলেন। ভেরী’সকল দিব্য পুষ্পে সমাকীর্ণ হইয়া ধ্বনিত হইত। কৃষ্ণসমবেত ভীম ও অর্জ্জুন ঐ ভেরীত্রয় ভগ্ন করিলেন এবং নানাপ্রকার অস্ত্ৰধারণ করিয়া দ্বারদেশ হইতে যেন জরাসন্ধের মস্তকে আঘাত করিতে করিতেই দ্রুতবেগে চৈত্যপ্রাকারের নিকট গমনপূর্ব্বক সুদৃঢ় বাহু দ্বারা সতত গন্ধমাল্যে অর্চিত, সুপ্রতিষ্ঠিত পুরাতন চৈত্যশৃঙ্গ ভগ্ন ও নিপাতিত করিয়া হষ্টচিত্তে মগধপুরে প্রবেশ করিলেন।
এই সময়ে বেদপারগ ব্রাহ্মণগণ দুর্নিমিত্ত দর্শন করিয়া জরাসন্ধকে জানাইলেন। পুরোহিতগণ তাঁহাকে হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণ করাইয়া অগ্নি প্ৰদক্ষিণ করাইলেন। প্রতাপশালী রাজা জরাসন্ধ সেই দুর্নিমিত্ত শান্তির নিমিত্ত দীক্ষিত ও নিয়মস্থ হইয়া উপবাস করিয়া রহিলেন। এদিকে স্নাতকবেশধারী কৃষ্ণ, ভীম ও ধনঞ্জয় সমস্ত অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ পরিত্যাগপূর্ব্বক জরাসন্ধের সহিত বাহুযুদ্ধ করিবার মানসে পুরপ্রবেশ করিলেন। তাঁহারা রাজমার্গে গমন করিতে করিতে নানাবিধ ভক্ষ্যদ্রব্য, মাল্য, আপণ [পণ্যবীথিকা-সারি সারি দোকান], অন্যান্য সমৃদ্ধি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন; মালাকারদিগের নিকট হইতে বলপূর্ব্বক মাল্য গ্রহণ করিলেন। সেই দিব্য কুণ্ডলধারী কৃষ্ণ, ভীম ও ধনঞ্জয়, যেমন সিংহ গোনিবাস [পশুগণের বাসস্থান] নিরীক্ষণ করিতে করিতে গমন করে, তদ্রূপ জরাসন্ধের নিকেতন লক্ষ্য করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। তৎকালে চন্দনঅগুরুচর্চিত সেই বীরত্ৰয়ের বাহু শালস্তম্ভের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। মগধপুরবাসী জনগণ উন্নত শালস্কন্ধের ন্যায় ও মদমত্ত কুঞ্জরের ন্যায়। সেই তিনজনকে দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইল। তাহারা ক্ৰমে ক্ৰমে বহুজনাকীর্ণ তিন কক্ষ অতিক্রম করিয়া অহঙ্কার প্রকাশপূর্ব্বক জরাসন্ধের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন।
ছদ্ম ভীমাদি দর্শনে জরাসন্ধের সন্দেহ
মহারাজ জরাসন্ধ তাঁহাদিগকে দর্শন করিবামাত্র গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক পাদ্য, মধুপৰ্ক প্রভৃতি দ্বারা পূজা করিয়া স্বাগতপ্রশ্ন করিলেন। ভীম ও ধনঞ্জয় তৎকালে মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন। তখন ধীমান কৃষ্ণ কহিলেন, “হে রাজেন্দ্ৰ! ইঁহারা নিয়মস্থ; এক্ষণে কথা কহিবেন না; পূর্ব্বরাত্র অতীত হইলে আপনার সহিত আলাপ করিবেন।” ভূপতি কৃষ্ণের বাক্যশ্রবণানন্তর তাহাদিগকে যজ্ঞাগারে রাখিয়া স্বীয় গৃহে গমন করিলেন এবং অৰ্দ্ধারাত্ৰসময়ে পুনরায় তাহাদের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। হে মহারাজ জনমেজয়! মগধরাজ জরাসন্ধের এই লোকবিশ্রুত ব্রত ছিল যে, কোন স্নাতক ব্ৰাহ্মণ অৰ্দ্ধারাত্ৰসময়ে সমুপস্থিত হইলেও তিনি তৎক্ষণাৎ গমন করিয়া তাহাকে প্রত্যুদগমন করিতেন। তিনি র্তাহাদের তিনজনের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া পূজা করিলেন এবং তাঁহাদের অপূর্ব্ব বেশ নিরীক্ষণ করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। তাঁহারা রাজাকে দেখিবামাত্ৰ “স্বস্ত্যস্তু” বলিয়া আশীর্ব্বাদপূর্ব্বক কুশল-প্রশ্ন করিলেন। রাজা জরাসন্ধ সেই ব্ৰাহ্মণবেশধারী বীরত্রয়কে বসিতে কহিলেন। তাহারাও তদনুসারে যজ্ঞশালায় উপবেশন করিয়া অধরস্থিত ত্রেতাগ্নির ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন সত্যসন্ধ মহারাজ জরাসন্ধ তাঁহাদের বেশদর্শনে বিস্মিত হইয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, “হি বিপ্ৰগণ! আমি জানি, স্নাতক ব্ৰতাচারী ব্রাহ্মণগণ সভাগমনসময় ব্যতীত কখন মাল্য বা চন্দন ধারণ করেন না। আপনারা কে? আপনাদের বস্ত্র রক্তবর্ণ, অঙ্গ পুষ্পমাল্য ও অনুলেপনে সুশোভিত, ভুজে জ্যাচিহ্ন লক্ষিত হইতেছে; আকারদর্শনে ক্ষত্ৰতেজের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে; কিন্তু আপনারা ব্ৰাহ্মণ বলিয়া পরিচয় দিতেছেন; অতএব সত্য বলুন, আপনারা কে? রাজসমক্ষে সত্যই প্রশংসনীয়। কি নিমিত্ত আপনারা দ্বারা দিয়া প্ৰবেশ না করিয়া নিৰ্ভয়ে চৈত্যকপর্ব্বতশৃঙ্গ ভগ্ন করিয়া প্রবেশ করিলেন? ব্রাহ্মণের বাক্য দ্বারা বীৰ্য্য প্রকাশ করিয়া থাকেন, কিন্তু আপনারা কাৰ্য্য দ্বারা উহা প্রকাশ করিয়া নিতান্ত বিরুদ্ধানুষ্ঠান করিয়াছেন। আরও, আপনারা আমার কাছে আসিয়াছেন, আমিও বিধিপূর্ব্বক পূজা করিয়াছি, কিন্তু কি নিমিত্ত পূজা গ্ৰহণ করিলেন না? যাহা হউক, এক্ষণে কি নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন, বলুন।”
মহারাজ জরাসন্ধ এইরূপ কহিলে মহামতি কৃষ্ণ স্নিগ্ধ-গম্ভীরস্বরে কহিতে লাগিলেন, “হে রাজন্! তুমি আমাদিগকে স্নাতক ব্রাহ্মণ বলিয়া বোধ করিতেছ; কিন্তু হে নরাধিপ! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন জাতিই স্নাতকব্রত গ্রহণ করিয়া থাকেন। ইহাদের বিশেষ নিয়ম ও অবিশেষ নিয়ম উভয়ই আছে। ক্ষত্ৰিয়জাতি বিশেষ নিয়মী হইলে সম্পত্তিশালী হয়, পুষ্পধারী নিশ্চয়ই শ্ৰীমান হয় বলিয়া আমরা পুষ্পধারণ করিয়াছি। ক্ষত্ৰিয় বাহুবলেই বলবান, বাগবীৰ্য্যশালী নহেন; এই নিমিত্ত তাঁহাদের অপ্ৰগল্ভ বাক্যপ্রয়োগ করা নিৰ্দ্ধারিত আছে। বিধাতা ক্ষত্ৰিয়গণের বাহুতেই বল প্ৰদান করিয়াছেন। হে রাজন্! যদি তোমার আমাদের বাহুবল দেখিতে বাসনা থাকে, তবে অদ্যই দেখিতে পাইবে সন্দেহ নাই। হে বৃহদ্রাথ-নন্দন! ধীর ব্যক্তিগণ শত্রুগৃহে অপ্রকাশ্যভাবে ও সুহৃদগৃহে প্রকাশভাবে প্রবেশ করিয়া থাকেন। হে রাজন! আমরা স্বকাৰ্য্য-সাধনাৰ্থে শত্রুগৃহে আগমন করিয়া তদত্ত পূজা গ্রহণ করি না; এই আমাদের নিত্য ব্ৰত।”