২০৮. খাণ্ডবপ্রস্থে পাণ্ডবগণের বাস
অষ্টাধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! মহাসত্ত্ব মহাবল পরাক্রান্ত মদীয় পিতামহগণ রাজ্যলাভানন্তর খাণ্ডবপ্রস্থে বাস করিয়া কোন্ কোন্ কর্ম করিয়াছিলেন, তাঁহাদের ধর্মপত্নী দ্রৌপদী একাকিনী হইয়া কিরূপে হাদের পাঁচজনের মনোরক্ষা করিয়াছিলেন, আর তাহারা পঞ্চভ্রাতাই বা কি প্রকারে একাকিনী দ্রৌপদীতে অনুরক্ত হইয়া অবিবাদে কালযাপন করিতেন, এইসমস্ত শ্রবণ করিতে আমার সাতিশয় অভিলাষ হইতেছে, আপনি অনুগ্রহপূর্বক বর্ণন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,—মহারাজ! পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞানুসারে রাজ্য প্রাপ্ত হইয়া কৃষ্ণা সমভিব্যাহারে খাণ্ডবপ্রস্থে বাস করিতে লাগিলেন। সত্য প্রতিজ্ঞ মহাতেজাঃ যুধিষ্ঠির রাজা হইয়া ভ্রাতৃচতুষ্টয় সমভিব্যাহারে ধর্মানুসারে প্রজাপালন করিতে লাগিলেন। সেই শত্রুক্ষয়কারী মহাপ্রাজ্ঞ, সত্যনিষ্ঠ, ধর্মপরায়ণ পঞ্চভ্রাতা পরমহ্লাদে তথায় বাস করত রাজাসনে উপবিষ্ট হইয়া সমস্ত পৌরকার্য সম্পাদন করিতেন।
একদা তাঁহাররা পঞ্চ ভ্রাতা একত্র হইয়া সুখে উপবিষ্ট আছেন, এমন সময়ে দেবর্ষি নারদ যদৃচ্ছাক্রমে তাঁহাদের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। মহাত্মা যুধিষ্ঠির তাহাকে উপবেশনার্থ এক মহার্হ আসন প্রদান করিলেন। দেবর্ষি উপবিষ্ট হইলে যথাবিধি অৰ্য্য প্রদান পুরঃসর তাঁহাকে সৎকার করিলেন। দেবর্ষি পূজা গ্ৰহণানন্তর পরম প্রীত হইয়৷ মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে আশীৰ্বাদ করিয়া আসিন পহি করিতে অনুমতি করিলেন। ধর্মাত্মা ধর্মনন্দন দেবর্ষির নিদেশানুরে আসনে উপবেশন করিয়া দ্রৌপদী সমীপে তদীয় আগমনবার্তা পাঠাইলেন। দ্রুপদরাজ-দুহিতা নারদেব আগমনবার্তা শ্রবণে শুচি ও সুসম্বতাঙ্গী হইয়া তাহার সমীপে আগমন করিলেন এবং চরণ বন্দনাপূর্বক কৃতাঞ্জলিপুটে বিনীতভাবে দণ্ডায়মান রহিলেন। দেবর্ষিসত্তম নারদ রাজনন্দিনী দ্রৌপদীকে বিবিধপ্রকার অশীৰ্বাদ করিয়া অন্তঃপুর গমনে অনুমতি করিলেন।
পাঞ্চালরাজতনয়া তথা হইতে গমন করিলে ঋষিশ্রেষ্ঠ নারদ নিভৃতে যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চ ভ্রাতাকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, হে পুরুষশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণ! তোমরা পঞ্চভ্রাতা; কিন্তু একাকিনী দ্রুপদতনয়া তোমাদের ধর্মপত্নী; অতএব যাহাতে তোমাদের পরস্পর ভ্রাতৃবিচ্ছেদ না হয়, এমন কোন উপায় বিধান কর। পূর্বকালে লোকত্রয়বিশ্রুত সুন্দ ও উপসুন্দ নামে দুই ভ্রাতা ছিল। তাহারা অন্যের অবধ্য। ঐ ভ্রাতৃদ্বয়ের পরস্পর এরূপ সৌহার্দ ছিল যে, তাহারা একত্র শয়ন, একত্র উপবেশন ও এক রাজ্য শাসন করিত। কেবল তিলোত্তমার নিমিত্ত বিবাদ করিয়া তাহারা। পরস্পরকে সংহার করিয়াছিল। তোমাদের পঞ্চভ্রাতারও এক্ষণে পরস্পর যৎপরোনাস্তি সৌহার্দ আছে, অতএব দেখিও যেন বিবাদ না হয়, এই নিমিত্তই আমি কোন সদুপায় স্থির করিতে কহিতেছি।
যুধিষ্ঠির কহিলেন, হে মহর্ষে! আপনি যে সুন্দ ও উপরে কৃথা, কহিলেন, তাহারা কাহার পুত্র? কি প্রকারে উৎপন্ন হইয়াছিল? কেনই বা তাহাদের পরস্পর ভেদ হইল? এবং কি করিয়াই বা পরস্পর পরস্পরকে সংহার করিয়াছিল? আর যে অপ্সরা তিলোত্তমার রূপলাবণ্য দর্শনে তাহারা কামান্ধ হইয়া পরস্পরের প্রাণ নাশ করে, সেই অপ্সরাই বা কাহার কন্যা? হে তপোধন! এই সমস্ত বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিতে আমার একান্ত বাসনা হইতেছে, আপনি অনুগ্রহপূর্বক সবিস্তর বর্ণন করুন।