২০৫. পতিব্ৰত্য-মাহাত্ম্য

২০৫তম অধ্যায়

পতিব্ৰত্য-মাহাত্ম্য

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! কৌশিকনামে এক তপঃপরায়ণ ধর্ম্মশীল ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। তিনি সাঙ্গোপনষ্যৎ বেদ অধ্যয়ন করিতেন। একদা ঐ বিপ্ৰ এক বৃক্ষমূলে বেদোচ্চারণ করিতেছিলেন, এমত সময়ে এক বলাকা [বকপক্ষী] ঐ বৃক্ষের উপরিভাগ হইতে তাঁহার গাত্রে পুরীষ পরিত্যাগ করিল। ব্রাহ্মণ তদর্শনে ক্ৰোধাভিভূত হইয়া বলাকার প্রতি দৃষ্টিপাত করিবামাত্র সে তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। বলাকা নিহত হইয়াছে দেখিয়া ব্ৰাহ্মণ কারুণ্যরসপরতন্ত্র হইয়া যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইলেন এবং ‘আমি রোষবশীভুত হইয়া নিতান্ত অকাৰ্য্য করিয়াছি’ বলিয়া বারংবার অনুতাপ করিতে লাগিলেন।

“তপোধনাগ্রগণ্য কৌশিক বলাকা-নিধন নিমিত্ত এইরূপ পুনঃ পুনঃ অনুতাপ করিয়া ভিক্ষার্থ গ্রামে প্রবেশপূর্ব্বক গৃহে গৃহে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। একদা তিনি পূর্ব্বাচরিত এক গৃহস্থভবনে প্রবেশপূর্ব্বক ভিক্ষা-প্রার্থনা করিলে ঐ গৃহস্থপত্নী তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “মহাশয়! ক্ষণকাল অপেক্ষা করুন, আমি ভিক্ষা আনয়ন করিতেছ।” গৃহিণী এই বলিয়া ভবনমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক ভিক্ষাপাত্র পরিষ্কৃত করিতেছেন, এমন সময় তাঁহার স্বামী ক্ষুধাতুর হইয়া আবাসে প্রবেশ করিল। ঐ পতিব্ৰতা কামিনী স্বীয় পতিকে সমাগত দেখিয়া ব্রাহ্মণের ভিক্ষা প্ৰদান না করিয়াই পাদ্য, আচমনীয়, আসন ও বিবিধ সুমধুর ভক্ষ্যদ্বারা অতি বিনীতভাবে স্বামীর পরিচর্য্যা করিতে লাগিলেন। হে ধর্ম্মানন্দন! ঐ কামিনী প্রত্যহ ভর্ত্তার উচ্ছিষ্ট ভোজন, তাঁহাকে দেবতার ন্যায় শুশ্রূষা ও মনোরঞ্জন করিতেন এবং সদাচারসম্পন্ন, দক্ষ ও কুটুম্ব-হিতৈষিণী ছিলেন; সতত সংযতচিত্তে দেবতা, অতিথি, ভৃত্য, শ্বশ্রূ ও শ্বশুরের শুশ্রূষা করিয়া কালযাপন করিতেন।

“পতিব্ৰতা স্বীয় স্বামীর সেবা করিতে করিতে ভিক্ষাকাঙ্ক্ষী ব্ৰাহ্মণকে অবলোকন করিয়া পূর্ব্ববৃত্তান্ত স্মরণপূর্ব্বক সাতিশয় লজ্জিত হইয়া ভিক্ষা প্ৰদান করিবার নিমিত্ত সমুপস্থিত হইলেন। তখন ব্রাহ্মণ রোষকষায়িতলোচনে তাহার প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বরাঙ্গনে! তুমি কি নিমিত্ত আমাকে ক্ষণকাল অপেক্ষা করিতে কহিয়া উপরুদ্ধ [আটক] করিলে? বিদায় করিলে না। কেন?”

“পতিব্ৰতা ব্ৰাহ্মণকে ক্ৰোধসন্তপ্ত দেখিয়া সান্ত্ববাদ প্রয়োগপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে বিদ্বন! আমার অপরাপ ক্ষমা করুন। আমি ভর্ত্তাকে পরমদেবতা বলিয়া জ্ঞান করি; তিনি ক্ষুধিত ও শ্রান্ত হইয়া আসিয়াছেন, অতএব আমি এতাবৎ সেবা করিতেছিলাম।”

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “তুমি ব্ৰাহ্মণগণকে গুরু বলিয়া জ্ঞান কর না, কিন্তু কেবল স্বামীকেই গুরুতর বোধ করিয়া থাক; তুমি গৃহস্থধর্ম্মে থাকিয়াও ব্রাহ্মণগণের অবমাননা কর, উহা অতি অনুচিত। হে গর্ব্বিতে! মানবের কথা দূরে থাকুক, ইন্দ্রও ব্রাহ্মণগণকে প্ৰণাম করিয়া থাকেন। নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, তুমি বৃদ্ধগণের নিকট সুদপদেশ শ্রবণ কর নাই; ব্রাহ্মণেরা অগ্নিসদৃশ, উহারা মনে করিলে অনায়াসেই বসুন্ধরা দগ্ধ করিতে সমর্থ হয়েন।’

“পতিব্ৰতা কহিলেন, “হে তপোধন! ক্ৰোধ পরিত্যাগ করুন, আমি বলাকা নহি, আপনি ক্ৰোধদৃষ্টিদ্বারা আমার কি করিবেন? আমি কদাচ দেবতুল্য মনস্বী ব্রাহ্মণগণকে অবজ্ঞা করি না। এক্ষণে আপনি আমার এই অপরাধ ক্ষমা করুন। আমি ব্রাহ্মণগণের তেজ ও মাহাত্ম্যের বিষয় বিলক্ষণরূপে অবগত আছি। ব্ৰাহ্মণগণের ক্ৰোধ-প্রভাবেই সমুদ্রের জল লবণাক্ত ও নিতান্ত অপেয় হইয়াছে। আর আমি কঠোরতপঃ মুনিগণের প্রভাব জ্ঞাত আছি; তাঁহাদের ক্ৰোধাগ্নি অদ্যাপি দণ্ডকারণ্যে প্ৰদীপ্ত রহিয়াছে। দেখুন, দূরাত্মা বাতাপি ব্রাহ্মণগণকে পরাভব করিয়াই মহর্ষি অগস্ত্যকর্ত্তৃক জীর্ণ হইয়াছে।

‘হে বিপ্ৰ! মহাত্মা ব্রাহ্মণগণের বহুবিধ প্রভাব জ্ঞাত হইয়াছি। তাঁহাদের যেমন ক্ৰোধ অসীম, প্রসাদও তদ্রূপ। হে ব্ৰহ্মন! আপনি আমার এই অপরাধ মার্জ্জনা করুন। আমার মতে পতিশুশ্রূষাই সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান ধর্ম্ম এবং ভর্ত্তা সমুদয় দেবগণ অপেক্ষাও প্রধান, আমি অবিচলিত ভক্তিসহকারে তাঁহার সেবা-শুশ্রূষা করিয়া থাকি। আপনি তাহার প্রত্যক্ষ ফল দেখুন, আপনি যে ক্রোধানলে বলাকা দগ্ধ করিয়াছেন, আমি তাহা জানিতে পারিয়াছি।

“হে বিপ্রেন্দ্ৰ! ক্ৰোধ মনুষ্যগণের পরমশত্রু। যিনি ক্ৰোধ, মোহ পরিত্যাগ করেন, সতত সত্যবাক্য কহেন ও গুরুজনকে সন্তুষ্ট করেন, যিনি হিংসিত হইয়াও হিংসা করেন না, সতত শুচি, জিতেন্দ্ৰিয় ধর্ম্মপরায়ণ ও স্বাধ্যায়নিরত হইয়া থাকেন এবং কাম, ক্ৰোধ প্রভৃতি রিপুবৰ্গকে বশীভূত করেন, যিনি সমুদয় লোককে আত্মবৎ বিবেচনা করেন ও সর্ব্বধর্ম্মে রত হয়েন, যিনি যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপন ও যথাশক্তি দান করিয়া থাকেন, যিনি ব্ৰহ্মচৰ্য্য অবলম্বনপূর্ব্বক অপ্ৰমত্ত হইয়া বেদাধ্যয়ন করেন, দেবগণ তাঁহাকেই যথার্থ ব্রাহ্মণ বলিয়া জানেন। ব্রাহ্মণগণ সদা সত্যবাক্য কহিয়া থাকেন, তাহাদের মন কখনই অনুতপ্রবণ [মিথ্যার আধিক্যপ্রকাশন] হয় না। বেদাধ্যয়ন, দম, আর্জ্জব, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহ ও সত্য এই কয়েকটি ব্ৰাহ্মণগণের কুশল চিন্তা করিবে। প্রাচীনেরা কহেন যে, শাশ্বত ধর্ম্ম অতি দুর্জ্ঞেয়, উহা সত্যেই প্রতিষ্ঠিত আছে এবং শ্রুতিই উহার , প্রমাণ; ফলতঃ ধর্ম্ম নানাপ্রকার, কিন্তু অতি সূক্ষ্ম পদার্থ। আপনি স্বাধ্যায়নিরত, শুচি, ধর্ম্মজ্ঞ; কিন্তু বোধ হয়, আপনি যথার্থ ধর্ম্ম জানেন না।

“হে ভগবন! যদি যথার্থ প্রকৃত ধর্ম্মের মর্ম্ম অবগত না থাকেন, তবে মিথিলায় গমনপূর্ব্বক ধর্ম্মব্যাধকে জিজ্ঞাসা করুন। ঐ ব্যাধ সত্যবাদী, জিতেন্দ্ৰিয়, সতত পিতামাতার সেবা করিয়া থাকে, সে আপনার নিকট ধর্ম্মকীর্ত্তন করিবে; আপনি তথায় গমন করুন। হে ব্ৰহ্মন! অবলাগণ ধার্ম্মিকদিগের অবধ্য, অতএব আপনি আমার এই রমণী-স্বভাবসুলভ বাচালতাদোষ মার্জ্জনা করুন।”

‘ব্রাহ্মণ কহিলেন, হে শোভনে! আমি তোমার প্রতি পরম প্রীত হইয়াছি, আমার ক্রোধেরও উপশম হইয়াছে। তোমার তিরস্কার-বাক্য আমার সাতিশয় হিতকর হইল, তোমার মঙ্গল হউক। এক্ষণে আমি চলিলাম।”

“তপোধন কৌশিক এইরূপে সেই পতিব্ৰতার নিকট বিদায় গ্ৰহণ করিয়া আত্মনিন্দা করিতে করিতে ভবনাভিমুখে গমন করিলেন।”