২০৫তম অধ্যায়
চিত্তচাঞ্চল্যকারক দুঃখনাশের উপদেশ
“মনু কহিলেন, ‘হে মহর্ষে! শারীরিক বা মানসিক দুঃখ বিদ্যমান থাকিতে যোগাভ্যাসে যত্ন হয় না; অতএব দুঃখচিন্তা পরিত্যাগ করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়; চিন্তা পরিত্যাগই দুঃখনিবারণের মহৌষধ। দুঃখ চিন্তা করিলে কখনই দুঃখের উপশম হয় না এবং উত্তরোত্তর পরিবর্দ্ধিত হইতে থাকে। প্রজ্ঞাবলে মানসিক এবং ঔষধবলে শারীরিক দুঃখ দূর করা অবশ্য কর্ত্তব্য। বালকতা প্রকাশপূর্ব্বক দুঃখে নিমগ্ন হওয়া কদাপি বিধেয় নহে। পণ্ডিত ব্যক্তিরা কখনই রূপ, যৌবন, জীবন, দ্রব্য, সম্পত্তি, আরোগ্য ও প্রিয়সহবাস প্রভৃতি অনিত্য বিষয়ের বাসনা করেন না। সাধারণ দুঃখের নিমিত্ত একাকী দুঃখ প্রকাশ করা বিধেয় নহে; বরং যদি উহার প্রতিকারের কোন উপায় থাকে, তাহা হইলে শোক প্রকাশ না করিয়া তাহাই করা কর্ত্তব্য। জীবিতাবস্থায় সুখ অপেক্ষা দুঃখই অধিকাংশকে ভোগ করিতে হয়। যে ব্যক্তি মোহবশতঃ ইন্দ্রিয়ের বশবর্তী হইয়া কার্য্যানুষ্ঠান করে, তাহাকে নিশ্চয়ই শমনের শাসনবৰ্ত্তী হইতে হয়। আর যিনি এককালে সুখদুঃখ উভয়ই পরিত্যাগ করেন, তিনি অনায়াসে ব্রহ্মে লীন হয়েন; বিদ্বান ব্যক্তিরা তাঁহার জন্য শোক প্রকাশ করেন না। অর্থ নিতান্ত অনর্থকর। অর্থের রক্ষণাবেক্ষণে যারপরনাই ক্লেশ হইয়া থাকে। আবার উহা উপার্জ্জন করিবার সময় অপরিমিত দুঃখ-ভোগ করিতে হয়; অতএব অর্থনাশের বিষয় চিন্তা করা কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে।
যোগসাধনায় মনের সমাধি
‘জ্ঞান আত্মা হইতে উৎপন্ন হয়। জ্ঞান মনের ধর্ম্ম। মন জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সহিত সংযুক্ত হইলেই বিষয়বুদ্ধির আবির্ভাব হইয়া। থাকে। ঐ বুদ্ধি সংস্কার সংযুক্ত [মার্জ্জিত-মালিন্য] হইয়া মনোমধ্যে বিরাজিত হইলেই যোগ সমাধিসহকারে ব্রহ্মজ্ঞান উপস্থিত হয়। সলিল যেমন পর্ব্বতশৃঙ্গ হইতে নির্গত হইয়া প্রবাহিত হইতে থাকে, তদ্রূপ ইন্দ্রিয়জ্ঞানসম্পন্ন বুদ্ধি অজ্ঞানান্ধকার হইতে নির্গত হইয়া রূপাদি গুণগ্রামে প্রবাহিত হয়। যখন সেই বুদ্ধিতে নির্গুণ ধ্যেয় বস্তু প্রাপ্ত হওয়া যায়, সেই সময় নিকষ[নিকষ পাষাণ—কষ্টিপাথর]খণ্ডস্থ স্বর্ণরেখার ন্যায় অসন্দিগ্ধরূপে ব্রহ্মজ্ঞানলাভ হইয়া থাকে। মন কেবল ইন্দ্রিয়গোচর রূপরসাদির প্রবোধক; উহাদ্বারা রূপাদি গুণবিহীন ব্ৰহ্মলাভ করা সম্ভাবিত নহে। সমুদয় ইন্দ্রিয় রোধ করিয়া উহাদিগকে কল্পনাত্মক মনে ও মনকে বুদ্ধিতে অবস্থানপূর্ব্বক একাগ্রতা অবলম্বন করিলেই ব্রহ্মের উপলব্ধি হয়। যেমন শব্দাদি গুণসমুদয় বিলুপ্ত হইলে পঞ্চীকৃত মহাভূতসকল বিলুপ্ত হয়, তদ্রূপ বুদ্ধি অহঙ্কারতত্ত্বে বিলীন হইলে ইন্দ্রিয়গণও বিলীন হইয়া যায়। যখন নিশ্চয়াত্মক বুদ্ধি অহঙ্কারে অবস্থান করে, তখন মনের সহিত উহার কিছুমাত্র বিভিন্নতা থাকে না। অহঙ্কার ধ্যানপ্রভাবে উৎকর্ষ লাভ করিয়া রূপাদি বিষয়ের সহিত সত্ত্বাদি মূলপ্রকৃতি প্রাপ্ত হইলেই গুণাত্মক সামগ্রীসমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক নির্গুণ বস্তু লাভ করিতে পারে।
‘অব্যক্তের স্বরূপ কীৰ্ত্তন করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। তপস্যা, অনুমান, শমদমাদিগুণ [অন্তর-ইন্দ্রিয় ও বাহ-ইন্দ্রিয়ের সংযম], বেদান্তশ্রবণ ও বিশুদ্ধ মনোবৃত্তিদ্বারা পরমব্রহ্মকে জানিতে বাসনা করা সকলেরই কর্ত্তব্য। তত্ত্বদর্শী ব্যক্তিরা সেই অতর্কীয় [তর্কের অযোগ্য—বেদান্তবাক্যে বিশ্বাসদ্বারা অনুভবনীয়] আনন্দস্বরূপ পরমব্রহ্মকে কি বাহ্যে, কি অন্তরে সর্ব্বত্রই অনুসন্ধান করিয়া থাকেন। হুতাশন যেমন অপ্রতিহতবেগে কাষ্ঠে পরিভ্রমণ করে, তদ্রূপ বুদ্ধি ও শব্দাদি বিষয়ের উপর পরিভ্রমণ করিয়া থাকে। যখন সেই বুদ্ধিবৃত্তি বিষয়বাসনাবিহীন হয়, তখনই ব্রহ্মজ্ঞানলাভ হইয়া থাকে; আর যখন বিষয়বাসনায় বিলিপ্ত হয়, তৎকালে ঐ জ্ঞান তিরোহিত হইয়া যায়। সুপ্তিকালে ইন্দ্রিয়সমুদয় যেমন স্ব স্ব কার্য্য হইতে বিমুক্ত হইয়া অবস্থান করে, তদ্রূপ আনন্দস্বরূপ পরমব্রহ্ম সৰ্ব্বদা সকল কাৰ্য্য হইতে বিমুক্ত হইয়া অবস্থান করিতেছেন। মানবগণ অজ্ঞানবশতঃ কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতেছে। উহাদের মধ্যে যাহারা কাৰ্য্য হইতে নিবৃত্ত হয়, তাহারা মোক্ষলাভ করিয়া থাকে; আর যাহারা উহাতে আসক্ত থাকে, তাহারা স্বর্গগমনে সমর্থ হয়। জীব, প্রকৃতি, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়, অহঙ্কার ও অভিমান এই সমুদয় বিনশ্বর পদার্থ। ঐ সমস্ত পদার্থের প্রথম সৃষ্টি ঈশ্বর হইতে হইয়াছে। তৎপরে ঐ সমস্ত সৃষ্ট পদার্থ হইতেই আবার সৃষ্টি হইয়া আসিতেছে। ঐরূপ পদার্থ সমুদয়ের ধর্ম্মপ্রভাবে শ্রেয়ঃ ও অধর্ম্মপ্রভাবে অমঙ্গল লাভ হইয়া থাকে। বিষয়াসক্ত ব্যক্তিরা মরণের পর পুনরায় জন্মপরিগ্রহ করে এবং বীতস্পৃহ [আসক্তিহীন] ব্যক্তিরা আত্মজ্ঞান প্রভাবে একবারে মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন।”