২০৪তম অধ্যায়
মার্কণ্ডেয় কর্ত্তৃক সতীধর্ম্মবৰ্ণনাবতারণা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, নৃপবর! তদনন্তর মহারাজ যুধিষ্ঠির ধর্ম্মানুসারে মহাতেজা মার্কণ্ডেয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে ভগবান! সূৰ্য্য, চন্দ্ৰমা, বায়ু, অগ্নি প্রভৃতি দেবগণ চিরকাল যাহা প্রত্যক্ষ অবলোকন ও পিতা-মাতা প্রভৃতি গুরুপরম্পরা যাহার অনুষ্ঠান করিয়া আসিয়াছেন, সেই সূক্ষ্ম, ধর্ম্ম, অন্যান্য বেদবিহত ধর্ম্ম এবং পরমোৎকৃষ্ট-স্ত্রীগণের মাহাত্ম্য শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ জন্মিয়াছে; অতএব হে ব্ৰহ্মন! আপনি পতিব্ৰতাদিগের মাহাত্ম্য কীর্ত্তন করুন। গুরু ও পতিব্ৰতা স্ত্রীগণ অবশ্য মান্য। তাঁহাদিগের শুশ্রূষা অতিশয় দুষ্কর। তাঁহারা যে ইন্দ্ৰিয়গ্রামনিরোধ, মনঃসংযম ও সদাচার অবলম্বনপূর্ব্বক স্বীয় পতিকে দেবতুল্য জ্ঞান করিয়া থাকেন, উহা নিতান্ত দুরূহ। সস্তানগণের পিতৃমাতৃশুশ্রূষা ও কামিনীগণের পতিসেবা এই উভয়ই নিতান্ত দুষ্করসাধনাসাপেক্ষ। কিন্তু ইহার মধ্যেও পতিশুশ্রূষার অপেক্ষা কঠিন কর্ম্ম আর কিছু দেখি না।
“কামিনীগণ যে পতিপরায়ণা ও সত্যবাদিনী হইয়া যথাকলে স্বামিসহযোগে গর্ভবতী হয়েন এবং দশ মাস সেই দুর্ব্বহ গৰ্ভভার বহনপূর্ব্বক পরিশেষে প্ৰাণপণে দুঃসহ বেদনা সহ্য করিয়া অতিকষ্টে সন্তান প্রসবপূর্ব্বক স্নেহসহকারে পোষণ করেন, ইহা এক অলৌকিক কাৰ্য্য। আর মানবেরা ক্রুরগণের মধ্যে বাস করিয়া লোকসমাজে নিন্দিত হইয়াও যে আপনার কর্ত্তব্যকর্ম্মে পরাঙ্মুখ না হয়, তাহাও নিতান্ত দুষ্কর কাৰ্য্য বলিতে হইবে সন্দেহ নাই। হে তপোধন! এক্ষণে পূর্বোক্ত ধর্ম্মসমুদয় ও ক্ষত্রিধর্ম্মের যথার্থ তত্ত্ব অনুগ্রহ করিয়া কীর্ত্তন করুন। দুরাত্মা নৃশংস ব্যক্তি কখনই ধর্ম্মানুষ্ঠান বা ধর্ম্মলাভ করিতে সমর্থ হয় না। হে ভৃগুবংশাবতংস! আমি আপনার নিকট উক্ত প্রশ্নানুযায়িক উত্তর শ্রবণ করিতে একান্ত বাসনা করি।”
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে ভরতকুলপ্ৰদীপ! আমি তোমার প্রশ্নানুসারে উক্ত সমুদয় বৃত্তান্ত কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। কোন কোন ব্যক্তি মাতাকে, কেহ কেহ বা পিতাকে অপেক্ষাকৃত গুরু বলিয়া জ্ঞান করেন। দেখ, মাতা অতিক্লেশে সন্তানগণকে লালনপালন করেন, পিতাও পুত্ৰলাভাকাঙক্ষায় তপস্যা, দেবযজন, বন্দন, তিতিক্ষা, অভিচার প্রভৃতি উপায় অবলম্বন করেন। এইরূপে বিবিধ কষ্টভোগ করিয়া পুত্রোৎপাদনপূর্ব্বক চিন্তা করেন যে, এই পুত্র কিরূপ হইবে। পিতা-মাতা পুত্ৰ হইতে যশ, কীর্ত্তি, ঐশ্বৰ্য্য, সন্তান ও ধর্ম্ম আকাঙক্ষা করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি পিতামাতার আশা পূর্ণ করে, সেই যথার্থ ধর্ম্মজ্ঞ। যে ব্যক্তি পিতামাতাকে নিত্য সন্তুষ্ট করিয়া থাকে, তাহার ইহকাল ও : পরকালে শাশ্বত ধর্ম্ম এবং কীর্ত্তিলাভ হয়। কামিনীগণ কেবল স্বীয় স্বামির শুশ্রূষাদ্বারাই স্বৰ্গলাভ করিতে পারে; কিন্তু যে রমণী পতির প্রতি ভক্তি না করে, কি যজ্ঞ, কি শ্ৰাদ্ধ, কি উপবাস, তাহার সকলই বৃথা হয়। হে যুধিষ্ঠির! আমি এই প্রকরণ অবলম্বন করিয়া তোমার নিকট পতিব্ৰতাদিগের ধর্ম্ম কীর্ত্তন করিব, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর।”