২০২. পাণ্ডব-পরাভবে কর্ণের মত
দ্বাধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
কর্ণ কহিলেন,—দুৰ্য্যোধন! তোমার প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত বোধ হইতেছে না। কৌশলদ্বারা তাহাদিগের অনিষ্টচেষ্টা করা নিরর্থক। পূর্বেও ত তুমি অতি সূক্ষম উপায়দ্বারা তাহাদিগের নিগ্রহচেষ্টা পাইয়াছিলে, কিন্তু তাহাতে কৃতকাৰ্য্য হইতে পার নাই। যখন পাণ্ডবের। শৈশবাবস্থায় সহায়বিহীন হইয়া এই স্থানেই বর্তমান ছিল, তুমি তৎকালেও তাহাদিগের কোন হানি করিতে পারি নাই। এক্ষণে ত তাহারা বৈদেশিক ও সহায়সম্পন্ন হইয়া সর্বতোভাবে প্রবল হইয়াছে; অতএব আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, তুমি উক্ত উপায়কলাপারা তাহাদিগকে নষ্ট করিতে পারিবে না এবং কোন প্রকার ব্যসনেও কলুষিত করিতে পারিবে না। তাহারা দৈববলে আত্মরক্ষায় সমুৰ্ধ হইয়া পিতৃপেতামহ পদের ইচ্ছুক ও উপযুক্ত হইআছে। যাহারা একপত্নীতে অনুরক্ত, তাহাদের সৌভ্রাত্র অবশ্যই বদ্ধমূল হইবে, সংশয় নাই; সুতরাং তাহাদিগের পরস্পর ভেদ উপস্থিত করাও নিতা সহজ ব্যাপার নহে। যে দ্রৌপদী তাদৃশ দীনাবস্থা নিরীক্ষণ করিয়াও পাণ্ডবদিগকে বরণ করিয়াছেন, অধুনা সেই দ্রৌপদী তাহাদিগের প্রতি বিরক্ত হইবেন, এ কথাও কোন ক্রমে সঙ্গত বোধ হয় না। বিশেষতঃ বহুভর্তৃতা স্ত্রীলোকদিগের অতীক আদরণীয়, কৃষ্ণ৷ সেই রমণীকুলবাঞ্ছিত ফল বিনা যন্ত্রে প্রাপ্ত হইয়াছেন; সুতরাং পতির প্রতি তাঁহার বিদ্বেষৰুদ্ধি উঃপাদন করিতে কোনক্রমেই সমর্থ হইবে না। পাঞ্চালের পরম ধার্মিক ও, ব্রতপরায়ণ; তাঁহার অর্থম্পৃহা নাই, তাঁহাকে অর্ধরাশি প্রদান করিলেও তিনি পাণ্ডবদিগকে পরিত্যাগ করিবেন না। তাঁহার পুত্রও গুণবান ও পাণ্ডবগণের প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত; অতএব স্পষ্ট প্রতীতি হইতেছে, পাণ্ডবেরা উপায়সাধ্য নহে। অতএব হে তাত! পাণ্ডবেরা বদ্ধমুল না হইতেই তাহাদিগকে যুদ্ধে বিনষ্ট করা আমাদিগের পক্ষে শ্রেয়ঃকল্প, আপনি তদ্বিযয়ে সবিশেষ মনোযোগী হউন। অম্মপক্ষ প্রবল ও পাঞ্চালপক্ষ হীনবল থাকিতে থাকিতেই তাহাদিগকে প্রহার করুন, আর বিলম্বের প্রয়োজন নাই। হে পার্থিব! যদবধি পাণ্ডবগণ গান্ধাররাজ্যে প্রভূত বাহন, অসংখ্যক বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের সাহায্য লাভ না করিতেছে, যদবধি পাঞ্চালরাজ মহাবলপরাক্রান্ত স্বীয় পুত্রগণ সমভিব্যাহারে তাহাদিগের সাহায্যার্থ বদ্ধপরিকর না হইতেছেন এবং যদুবংশাবতংস কৃষ্ণ যাবৎ পাণ্ডবগণের রাজ্যের নিমিত্ত যাদববাহিনী লইয়া পাঞ্চালরাজসদনে সমাগত না হইতেছেন, তৎকালমধ্যে আপনি বিক্রম প্রকাশ করুন। যদি পাণ্ডবগণের নিমিত্ত সমস্ত ধনসম্পতি, অশেষ ভোগসুখ ও রাজ্য পৰ্যন্তও পরিত্যাগ করিতে হয়, কৃষ্ণ তাহাতেও কখন পান্মুখ হইবেন না। হে মহারাজ! বিক্রমই ক্ষত্রিয়দিগের স্বাভাবিক ধর্ম। দেখুন, মহাত্মা ভরত বিক্রমদ্বারা পৃথিবী জয় করিয়াছেন এবং ইন্দ্র ত্রিলোকীর আধিপত্য প্রাপ্ত হইয়াছেন। আমরা ভবদীয় চতুরঙ্গিণী সেনা সমভিব্যাহারে ত্বরায় দ্রুপদের প্রাণ সংহারপূর্বক পাণ্ডবদিগকে আনয়ন করি। তাহাদিগের প্রতি সমি, দান, ভেদ, এই ত্রিবিধ উপায় প্রযুক্ত হইলেও নিষ্ফল হইবে। তাহাদিগকে পরাজয় করিতে কেবল একমাত্র বিক্রমই সাধীয়া উপায় আছে। অতএব বিক্ৰম প্ৰকাশদ্বারা তাহাদিগকে পরাভুত করিয়া অখণ্ড সাম্রাজ্য নিষ্কণ্টকে সম্ভোগ করুন। মহারাজ! বিক্রম ভিন্ন বিজয় লাভের আর কোন উপযুক্ত উপায়ান্তর লক্ষ্য হয় না।
রাধেয়বচন শ্রবণানন্তর ধৃতরাষ্ট্র তাঁহার প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শন পূর্বক কহিলেন, হে কৃতাস্ত্র মহাপ্রাজ্ঞ সূতনন্দন! ঈদৃশ বিক্রমসম্পন্ন বাক্য প্রয়োগ করা তোমার উপযুক্ত বটে, সন্দেহ নাই, কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর এবং তোমরা দুই জন পুনর্বার মন্ত্রণা করিয়া যাহা আমাদিগের শ্রেয়স্কর বিবেচনা হয়, কর। অনন্তর রাজা ধৃতরাষ্ট্র পূর্বোক্ত মন্ত্রিদিগকে অনিয়নপূর্বক তাহাদিগেয় সহিত মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন।