২০২. অর্জ্জুন-অশ্বত্থামার যুদ্ধ–কৌরবপরাজয়

২০২তম অধ্যায়

অর্জ্জুন-অশ্বত্থামার যুদ্ধ–কৌরবপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় সেই সমস্ত সৈন্যগণকে ছিন্নভিন্ন দেখিয়া অশ্বত্থামাকে সংহার করিবার বাসনায় তাহাদিগকে নিবারণ করিলেন। সৈন্যগণ অর্জ্জুন ও বাসুদেবের প্রযত্নে নিবারিত হইয়া তথায় অবস্থান করিতে লাগিল। তখন একমাত্র ধনঞ্জয়, সোমক, যবন, মৎস্য ও অন্যান্য কৌরবগণের সহিত সমবেত হইয়া অবিলম্বে সিংহলাঙ্গুলধ্বজ অশ্বত্থামার নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে গুরুপুত্র! তুমি পুনরায় আমাকে তোমার সেই বল, বীৰ্য্য, জ্ঞান, পুরুষকার, দিব্যতেজ এবং ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের প্রতি প্রীতি ও আমাদিগের প্রতি বিদ্বেষবুদ্ধি প্রদর্শন কর। এক্ষণে দ্রোণসংহারকারী মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নই তোমার অহঙ্কার চূর্ণ করিবেন; অতএব তুমি সেই কালানলতুল্য বিপক্ষগণের অন্তসদৃশ ধৃষ্টদ্যুম্নের এবং আমার ও বাসুদেবের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তুমি অতিশয় উদ্ধত, আমি অদ্যই তোমার দর্প চূর্ণ কর।’ ”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলে, “হে সঞ্জয়! দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা মহাবলপরাক্রান্ত ও সম্মানভাজন। অর্জ্জুনের প্রতি তাঁহার সবিশেষ প্রীতি আছে এবং অর্জ্জুনও তাঁহার প্রতি সমুচিত সদ্ভাব প্রদর্শন করিয়া থাকে। অর্জ্জুন স্বীয় প্রিয়সখা অশ্বত্থামাকে লক্ষ্য করিয়া পূর্ব্বে কখনই এইরূপ কঠোর বাক্য প্রয়োগ করে নাই; কিন্তু আজ কি নিমিত্ত তাঁহাকে এইরূপ কহিল?”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! ইতিপূর্ব্বে যুধিষ্ঠিরের সেই সমস্ত বাক্যে মহাবীর ধনঞ্জয়ের মর্ম্মদেশ নিতান্ত ব্যথিত হইয়াছিল। এক্ষণে আবার চেদিদেশীয় যুবরাজ, পুরুবংশীয় বৃহৎক্ষত্র ও মালবদেশীয় সুদর্শন নিহত এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি ও ভীমসেন পরাজিত হইলে পূর্ব্বদুঃখসমুদয় স্মৃতিপথে সমারূঢ় হওয়াতে তাঁহার অন্তঃকরণে অভূতপূর্ব্ব ক্রোধের উদ্রেক হইল। এই নিমিত্তই তিনি কাপুরুষের ন্যায় সম্মানভাজন অশ্বত্থামার উপর নিতান্ত অনুপযুক্ত, অশ্লীল ও অপ্রিয় বাক্য প্রয়োগ করিলেন। হে মহারাজ! আচাৰ্য্যতনয় ক্রোধোপহতচিত্তে ধনঞ্জয়কর্ত্তৃক এইরূপে অভিহিত হইয়া তাঁহার ও বিশেষতঃ বাসুদেবের উপর সাতিশয় রোষাবিষ্ট হইলেন। তখন তিনি আচমনপুরঃসর যত্নসহকারে দেবগণেরও দুর্দ্ধর্ষ বিধূম পাবকসদৃশ আগ্নেয়-অস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক মন্ত্রপূত করিয়া দৃশ্য ও অদৃশ্য শত্রুগণের উদ্দেশ্যে চতুর্দ্দিকে নিক্ষেপ করিলেন। সেই অস্ত্রের প্রভাবে নভোমণ্ডলে জ্বালাকরাল ভীষণ শরবৃষ্টি প্রাদুর্ভূত হইয়া অর্জ্জুনকে পরিবেষ্টিত করিল। ঐ সময় গগনতল হইতে মহোল্কাসকল নিপতিত হইতে লাগিল। ক্ষণকাল মধ্যে গাঢ়তর অন্ধকার সহসা সেনাগণকে সমাচ্ছন্ন করিল। দিঙ্মণ্ডল অপ্রকাশিত হইল। রাক্ষস ও পিশাচগণ সমবেত হইয়া ভীষণ নিনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। অমঙ্গলজনক সমীরণ প্রবাহিত হইল। সূর্য্যদেব আর উত্তাপপ্রদানে সমর্থ হইলেন না। বায়স চতুর্দ্দিকে ভয়ঙ্কররবে চীৎকার করিতে লাগিল। জলদজাল রুধিরধারাবর্ষণপূর্ব্বক গভীর গর্জ্জন করিতে আরম্ভ করিল। তৎকালে গো প্রভৃতি পশু, পক্ষী ও ব্রতপরায়ণ মুনিগণ শান্তিলাভে সমর্থ হইলেন না। মহাভূতসকল পরিভ্রমণ করিতে লাগিল; বোধ হইল যেন, সূর্যের সহিত সমুদয় বিশ্ব উদ্ভ্রান্ত ও জ্বরাবিষ্টের ন্যায় নিতান্ত সন্তপ্ত হইতেছে। মাতঙ্গগণ অস্ত্রতেজে সাতিশয় সন্তপ্ত হইয়া তাহা হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগপূর্ব্বক ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। জলাশয়সকল সন্তপ্ত হওয়াতে তন্মধ্যস্থিত জীবজন্তুগণ তেজঃপ্রভাবে দগ্ধপ্রায় হইয়া কোনক্রমেই শান্তিলাভে সমর্থ হইল না। সময় দিঙ্মণ্ডল ও নভোমণ্ডল হইতে গরুড় ও সমীরণের তুল্য বেগশালী নানাবিধ শরনিকর প্রাদুর্ভূত হইতে লাগিল। অরাতিগণ মহাবীর অশ্বত্থামার বজ্ৰবেগতুল্য সেই সমস্ত শরদ্বারা সমাহত ও দগ্ধ হইয়া অনলদগ্ধ পাদপের ন্যায় নিপতিত হইল। উন্নতকায় মাতঙ্গগণ শরানলে দগ্ধ হইয়া জলধরের ন্যায় গভীর গৰ্জন করিয়া ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। তন্মধ্যে কতকগুলি অরণ্যমধ্যে দাবানলপরিবেষ্টিত হইয়াই যেন ভীতচিত্তে অনবরত চীৎকার করিয়া ধাবমান হইল। অশ্ব ও রথসকল কাননমধ্যে দাবানলদগ্ধ মহীরুহশিখরের ন্যায় দৃষ্টিগোচর হইতে লাগিল। বহুসংখ্যক রথ ভস্মীভূত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। এইরূপে ভগবান হুতাশন প্রলয়কালীন সংবৰ্ত্তক অনলের ন্যায় সেই পাণ্ডবসৈন্যগণকে দগ্ধ করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! আপনার পক্ষীয় বীরগণ এইরূপে অশ্বত্থামার শরপ্রভাবে পাণ্ডবসৈন্যগণকে দগ্ধ হইতে দেখিয়া হৃষ্টমনে সিংহনাদপরিত্যাগপূর্ব্বক অবিলম্বে তুৰ্য্যধ্বনি করিতে লাগিলেন। তৎকালে চতুর্দ্দিক অন্ধকারসমাচ্ছন্ন হওয়াতে মহাবীর অর্জ্জুন ও সমস্ত সৈন্যগণকে আর কেহই দেখিতে পাইল না। হে মহারাজ! দ্রোণাত্মজ অশ্বত্থামা ঐ সময় ক্রোধভরে যেরূপ অস্ত্রপ্রয়োগ করিয়াছিলেন, আমরা পূর্ব্বে আর কখনই সেরূপ অস্ত্র দর্শন বা শ্রবণ করি নাই।

“এইরূপে অশ্বত্থামার শরজালপ্রভাবে সমুদয় সৈন্য নিতান্ত নিপীড়িত হইলে মহাবীর ধনঞ্জয় উহা প্রতিহত করিবার নিমিত্ত ব্ৰহ্মাস্ত্র পরিত্যাগ করিলেন। তখন মুহূর্ত্তকালমধ্যে সেই গাঢ়তর অন্ধকার নিরাকৃত ও দিণ্ডল সুনির্ম্মল হইল; সুশীতল অনিল প্রবাহিত হইতে লাগিল; ঐ সময়ে আমরা সেই অক্ষৌহিণী সেনা অস্ত্রতেজে দগ্ধ ও অনভিব্যক্তরূপে নিহত নিরীক্ষণ করিলাম। অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় ও বাসুদেব ঘোর অন্ধকার হইতে বিমুক্ত হইয়া অক্ষতশরীরে পতাকা, ধ্বজ, রথ, অশ্ব, অনুকর্ষ ও আয়ুধের সহিত সুশোভিত এবং নভোমণ্ডলে চন্দ্ৰসূর্যের ন্যায় অবলোকিত হইলেন। তখন পাণ্ডবগণ একান্ত হৃষ্ট হইয়া মুহূর্ত্তকালমধ্যে তুমুল কোলাহল এবং শঙ্খ ও ভেরিধ্বনি করিতে লাগিলেন। উভয়পক্ষীয় সেনাগণ কেশব ও অর্জ্জুনকে তেজঃসমাচ্ছন্ন নিরীক্ষণ করিয়া নিহত বলিয়া স্থির করিয়াছিল, এক্ষণে ঐ বীরদ্বয়কে অক্ষত দেখিয়া হৃষ্টান্তঃকরণে শঙ্খধ্বনি করিতে আরম্ভ করিল। তখন কৌরবগণ পাণ্ডবদিগকে প্রফুল্লচিত্ত নিরীক্ষণ করিয়া একান্ত ব্যথিত হইলেন।

“অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে তেজঃপ্রতিমুক্ত অবলোকন করিয়া দুঃখিতমনে মুহূর্ত্তকাল তদ্বিষয়ে চিন্তা করিতে লাগিলেন এবং পরিশেষে শোকাকুলচিত্তে বিষন্নমনে দীর্ঘ উষ্ণনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কাৰ্ম্মক পরিহারপূর্ব্বক মহাবেগে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া ‘অহো ধিক! সমুদয়ই মিথ্যা’ এই কথা বারংবার উচ্চারণ করিয়া রণস্থল হইতে মহাবেগে গমন করিতে লাগিলেন।

অস্ত্রব্যর্থতার কারণ জিজ্ঞাসায় ব্যাসের উত্তর

“অনন্তর অশ্বত্থামার গমনকালে নীরদশ্যামল বেদবিভক্তা [বেদের বিভাগকর্তা] দেবী সরস্বতীর আবাসস্বরূপ ব্যাসদেব তাঁহার সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন। দ্রোণতনয় মহাত্মা কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে নিরীক্ষণ করিয়া অভিবাদনপূর্ব্বক দীনভাবে ক্ষীণকণ্ঠে কহিলেন, ‘ভগবন্! আমার অস্ত্র কি নিমিত্ত নিষ্ফল হইল? কোন্ মায়াপ্রভাবে বা আমার কোন্ ব্যতিক্রম হওয়াতে এই শক্তির অনিয়ম ঘটিয়াছে, তাহা আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছি না। কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় যে জীবিত আছেন, ইহা নিতান্ত আশ্চৰ্য্য। যাহা হউক, কালকে অতিক্রম করা নিতান্ত দুষ্কর। আমি অস্ত্র প্রয়োগ করিলে কি অসুর, কি গন্ধর্ব্ব, কি পিশাচ, কি রাক্ষস, কি সর্প, কি পক্ষী, কি মানুষ, কেহই উহা নিষ্ফল করিতে সমর্থ হয় না। কিন্তু এক্ষণে সেই মৎপ্রযুক্ত মর্ম্মঘাতী অস্ত্র কেবল সেই অক্ষৌহিণী সেনা বিনাশ করিয়াই প্রশান্ত হইল। মর্ত্যধর্ম্মপরায়ণ কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় কি নিমিত্ত উহাতে বিনষ্ট হইলেন না? হে ভগবন্! আপনি ইহার যথার্থ স্বরূপ কীৰ্ত্তন করুন, শ্রবণ করিতে আমার অতিশয় অভিলাষ হইতেছে।’

কৃষ্ণ অর্জ্জুন-অশ্বত্থামার পূর্ব্ববৃত্তান্ত

“মহাত্মা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দ্রোণপুত্ৰকৰ্তৃক এইরূপে প্রার্থিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে ভারদ্বাজতনয়! তুমি বিস্ময়ান্বিত হইয়া আমাকে যে গুরুতর বিষয় জিজ্ঞাসা করিতেছ, তাহা সমস্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। পূর্ব্বকালে পূর্ব্বতন লোকদিগের পূর্ব্বজ বিশ্বকৰ্ত্তা ভগবান্ নারায়ণ দেবকাৰ্য্যসাধনার্থ ধর্মের পুত্র হইতে জন্ম পরিগ্রহ করেন। সেই সূৰ্য্য ও অনলপ্রতিম কমললোচন মহাতেজাঃ হিমালয় পর্ব্বতে প্রথমতঃ ষষ্টিলক্ষ ও ষষ্টিসহস্র বৎসর উৰ্দ্ধবাহু হইয়া বায়ুভক্ষণপূর্ব্বক কঠোর তপানুষ্ঠান করিয়া আত্মাকে পরিশুষ্ক করিয়াছেন। তৎপরে তিনি পূর্ব্বাপেক্ষা দ্বিগুণকাল অন্য কঠোর তপশ্চরণ করিয়া তেজঃপ্রভাবে রোদসী [অন্তরীক্ষ] পরিপূরিত করিলেন এবং পরিশেষে সেই তপঃপ্রভাবে নিতান্ত নির্লেপ্ত [নির্ম্মল] হইয়া একান্ত দুর্নিরীক্ষ্য দেবাদিদেব বিশ্বযোনি জগৎপতি পশুপতির সন্দর্শনলাভে কৃতকাৰ্য্য হইলেন। মহাত্মা ত্রিপুরনিসূদন শম্ভু সর্ব্বদেবের প্রভু এবং সূক্ষ্ম হইতেও সূক্ষ্মতর ও মহৎ হইতেও মহত্তর। তিনি রুদ্র, ঈশান, হর, জটাজুটধারী, চৈতন্যস্বরূপ এবং স্থাবর ও জঙ্গমের নিদানভূত। তিনি শুভ্র, দুনিৰ্বার, তিগ্মমন্যু [উগ্রক্রোধী], সর্ব্বসংহর্তা, প্রচেতা, অনন্তবীৰ্য্য এবং দিব্যশরাসন, তূণীর, হিরণ্যবর্ম্ম, পিনাক, বজ্র, শূল, পরশু, গদা, সুদীর্ঘ অসি ও মুষলধারী। অহি তাহার যজ্ঞোপবীত, পরিধেয় ব্যাঘ্রাজিন, করে দণ্ড ও বাহুতে অঙ্গদ; তিনি সতত জীবসমূহে পরিবেষ্টিত, অদ্বিতীয় পুরুষ ও তপস্যার নিধান। বৃদ্ধেরা ইষ্টবাক্যদ্বারা সতত তাঁহাকে স্তুতি করিয়া থাকেন। তিনি স্বর্গ, মর্ত্ত, চন্দ্র, সূৰ্য্য, বায়ু, জল, অগ্নি ও এই জগতের পরিণাম। দুরাচারেরা কখনই সেই মোক্ষদাতাব্রহ্মবেদী, নিহন্তা আদিপুরুষের দর্শনে সমর্থ হয় না। বিশুদ্ধবৃত্ত ব্রাহ্মণগণ বিশোক ও নিস্পাপ হইলে তাহার দর্শনলাভ করিতে পারেন।

‘হে ভারদ্বাজতনয়! ভগবান্ নারায়ণ সেই তেজোনিধান, অক্ষমালাধারী পার্ব্বতীর সহিত ক্রীড়মান, অন্ধকনিপাতক বিরূপাক্ষকে দর্শন করিয়া হৃষ্টচিত্তে সাষ্টাঙ্গপ্রণিপাতপুরঃসর ভক্তিভাবে তাঁহাকে স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন, হে আদিদেব! হে বরেণ্য! দেবগণেরও পূর্ব্বজ, যে প্রজাপতিগণ এই বসুন্ধরা রক্ষা করিতেছেন, তাঁহারা সকলেই তোমার দেহসম্ভূত। তুমি সুর, অসুর, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, বক্ষ, পিশাচ, নাগ, নর, সুপর্ণ প্রভৃতি বিবিধ জীবগণের সৃষ্টিকর্তা। তোমার নিমিত্ত ইন্দ্র, যম, বরুণ, কুবের, বিশ্বকর্ম্মা, সোম ও পিতৃলোকেরা স্ব স্ব কাৰ্য্য সাধন করিতেছেন। রূপ, জ্যোতি, শব্দ, আকাশ, বায়ু, স্পর্শ, আজ্য, সলিল, গন্ধ, উৰ্ব্বী, কাল, ব্রহ্মা, ব্রাহ্মণ, বেদ এবং চরাচর বিশ্ব তোমা হইতে উদ্ভূত হইয়াছে; তোমার প্রভাবে সলিলরাশি পৃথক পৃথক্‌ অবস্থিত রহিয়াছে; কিন্তু প্রলয়কাল উপস্থিত হইলে সমস্ত একাকার হয়। কৃতবিদ্য ব্যক্তি প্রাণীগণের এইরূপ উৎপত্তি ও সংহার অবগত হইয়া তোমার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকেন। তুমি স্বপ্রকাশ, সত্যস্বরূপ মনোগম্য, জীবাত্মা ও পরমাত্মারূপ দুইটি পক্ষী, চতুর্বিধ বাক্যরূপ শাখাসম্পন্ন পিপ্পলবৃক্ষ এবং পঞ্চমহাভূত, মন ও বুদ্ধি—এই সাত ও শরীর প্রতিপালক অন্য দশ ইন্দ্রিয়রূপ রক্ষকের সৃষ্টি করিয়াছ। কিন্তু তুমি ঐ সমুদয় হইতে স্বতন্ত্র। অনন্ততত্ত্বপ্রযুক্ত তুমি অনিৰ্দেশ্য; ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান এই কালত্রয় তোমারই সৃষ্ট এবং তোমা হইতেই সপ্তভুবন ও বিশ্বসংসার উৎপন্ন হইয়াছে। হে দেব! আমি তোমার নিতান্ত ভক্ত; এক্ষণে প্রার্থনা করিতেছি, তুমি আমার প্রতি কৃপাদৃষ্টি প্রদান কর। তুমি বিপক্ষেরও বিপক্ষ, এক্ষণে আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ কর; বিপক্ষতাচরণ করিও না। তুমি বৃহৎ, প্রকাশস্বরূপ, দুর্জ্ঞেয় ও আত্মা; লোকে তোমার তত্ত্ব অবগত হইলেই তোমাকে প্রাপ্ত হইয়া থাকে।

‘হে দেবপ্রধান! তুমি সর্ব্বজ্ঞ ও স্বধর্ম্মবেদ্য; আমি তোমাকে অর্চনা করিবার নিমিত্ত তোমার স্তুতিবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি বিকৃত না হইয়া আমাকে আমার অভিলষিত নিতান্ত দুর্লভ বর প্রদান কর।

‘হে দ্রোণপুত্র! নারায়ণ অচিন্ত্যাত্মা পিনাকপাণি নীলকণ্ঠকে এইরূপে স্তব করিলে তিনি তাঁহাকে বর প্রদান করিয়া কহিলেন,-হে নারায়ণ! আমি তোমার প্রতি প্রীত হইয়া কহিতেছি যে, মনুষ্য, দেব, দানব ও গন্ধর্ব্বগণের মধ্যে কেহই তোমার তুল্য বলশালী হইবে না। দেব, অসুর, উরগ, পিশাচ, গন্ধর্ব্ব, নর, রাক্ষস বা সুপর্ণগণ বিশ্বমধ্যে কেহই তোমাকে পরাস্ত করিতে পারিবে না। তুমি সমরাঙ্গনে আমা হইতে অধিক পরাক্রমশালী হইবে; আমার প্রসাদে কোন ব্যক্তিই কি শস্ত্র, কি বজ্র, কি অগ্নি, কি বায়ু, কি আর্দ্র বস্তু, কি শুষ্ক পদার্থ, কি স্থাবর, কি জঙ্গম দ্রব্য, কিছুতেই তোমার ক্লেশোৎপাদন করিতে সমর্থ হইবে না। হে ভারদ্বাজতনয়! পূর্ব্বকালে হৃষীকেশ এইরূপ বর লাভ করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনি বাসুদেবরূপে মায়াপ্রভাবে সমুদয় জগন্মণ্ডল মুগ্ধ করিয়া বিচরণ করিতেছেন। মহাত্মা অর্জ্জুন তাহা অপেক্ষা ন্যূন নহেন। উনি সেই নারায়ণের তপঃপ্রভাবসঞ্জাত নরনামা মহর্ষি। ঐ দুই মহাত্মা আদ্য দেবগণেরও শ্রেষ্ঠ। উঁহারা লোকযাত্রাবিধানের নিমিত্ত যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন। হে মহামতে! তুমিও সেই কর্ম্ম এবং তপোবলে তেজঃ ও ক্রোধমুক্ত হইয়া রুদ্রদেবের অংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছ। তুমি পূর্ব্বজন্মে একজন দেবতুল্য বিজ্ঞ মুনি ছিলে। তুমি এই জগৎকে মহেশ্বরময় জ্ঞান করিয়া তাঁহার প্রিয়চিকীর্ষায় নিয়মদ্বারা আত্মাকে পরিক্লিষ্ট এবং পরমপবিত্র মন্ত্র জপ, হোম ও উপহারাদিদ্বারা সেই দেবাদিদেবকে অর্চিত করিয়াছ। ভগবান্ রুদ্রদেব তোমার পূজায় প্রীত হইয়া তোমাকেও অভিমত উৎকৃষ্ট বরসকল প্রদান করেন। কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের জন্ম, কর্ম্ম ও তপস্যা যেরূপ উৎকৃষ্ট, তোমারও তদ্রূপ। তাঁহারা যেরূপ যুগে যুগে দেবাদিদেবকে লিঙ্গে অর্চনা করিয়াছেন, তুমিও তদ্রূপ করিয়াছ। যিনি মহাদেবকে সর্ব্বরূপ অবগত হইয়া সতত শিবলিঙ্গ অর্চনা করিয়া থাকেন, ইনি সেই রুদ্রসম্ভূত ও রুদ্রভক্ত কেশব। উহাতে আত্মযোগ ও শাস্ত্রযোগ নিরন্তর বিদ্যমান আছে। দেবগণ, সিদ্ধগণ ও মহর্ষিগণ পরলোকে উৎকৃষ্ট স্থানলাভার্থ সতত তাঁহার অর্চনা করিয়া থাকেন; ভগবান বাসুদেব শিবলিঙ্গকে সর্ব্বভূতের উৎপত্তিকারণ জানিয়া সতত অর্চনা করেন; মহাত্মা বৃষধ্বজও কৃষ্ণের প্রতি বিশেষ প্রীতি প্রদর্শন করিয়া থাকেন। অতএব বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক কৃষ্ণের অর্চনা করা অবশ্য কর্ত্তব্য।’

“হে মহারাজ! জিতেন্দ্রিয় মহারথ দ্রোণপুত্র বেদব্যাসের সেই বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া রুদ্রদেবকে নমস্কার ও কেশবকে মহান বলিয়া জ্ঞান করিতে লাগিলেন। তাঁহার গাত্র পুলকিত হইয়া উঠিল। তিনি তৎপরে মহর্ষি বেদব্যাসকে অভিবাদনপূর্ব্বক সৈন্যমধ্যে প্রত্যাগত হইয়া অবহার করিলেন, তখন পাণ্ডবগণও অবহারে প্রবৃত্ত হইলেন। হে মহারাজ! এইরূপে বেদপারদর্শী ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য্য পাঁচ দিন মাত্র যুদ্ধ করিয়া অসংখ্য সেনা বিনাশপূর্ব্বক ব্রহ্মলোকে গমন করিলেন। সমরাঙ্গনে আচার্য্য নিহত হওয়াতে কৌরবগণের দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না।”