২০০তম অধ্যায়
সমবেত কুরুপাণ্ডব যুদ্ধারম্ভ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর দ্রোণনন্দন অশ্বত্থামা কপ্লান্তকালীন অন্তকের ন্যায় শত্রু বিনাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। তঁহার ভল্লাস্ত্রের আঘাতে অসংখ্য অরাতি নিপাতিত হওয়াতে সমরাঙ্গন পর্ব্বতের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। ধ্বজসকল উহার বৃক্ষ, অস্ত্রসমুদয় শৃঙ্গ, গতাসু গজনিচয় মহাশিলা, অশ্বগণ কিংপুরুষ, শরাসনসকল লতা, রাক্ষসগণ, পক্ষী ও ভূতসমুদয় যক্ষগণের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা মহাসিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক পুনরায় দুর্য্যোধনকে প্রতিজ্ঞা শ্রবণ করাইয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে রাজন্! আমি সত্য বলিতেছি, যখন কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির ধর্ম্মযুদ্ধপ্রবৃত্ত আচার্য্যকে অস্ত্রপরিত্যাগে বাধ্য করিয়াছেন, তখন আজ তাঁহার সমক্ষেই পাণ্ডবসৈন্য বিদ্রাবিত করিয়া দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিনষ্ট করিব। আর যদি পাণ্ডবপক্ষীয়েরা রণে পরাজুখ না হইয়া আমার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে সকলেই আমার হস্তে নিহত হইবে। তুমি আমাদিগের সেনাসমুদয় প্রতিনিবৃত্ত কর।’
“হে মহারাজ! আপনার পুত্র দ্রোণতনয়ের সেই কথা শ্রবণ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক সৈন্যগণকে ভয়শূন্য করিয়া প্রতিনিবৃত্ত করিলেন। পরিপূর্ণ অর্ণবদ্বয়ের ন্যায় পুনরায় কৌরব ও পাণ্ডবসৈন্যের ভয়ানক সমাগম সমাহিত হইল। কৌরবগণ অশ্বত্থামার উত্তেজনায় স্থিরচিত্ত হইলেন এবং পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ আচার্য্যনিধনে নিতান্ত হৃষ্ট ও উদ্ধত হইয়া উঠিলেন। এইরূপে সেই উভয়পক্ষীয় বীরগণ জয়লাভে কৃতনিশ্চয় হইয়া সমরাঙ্গনে মহাবেগে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন পর্ব্বত পর্ব্বতে এবং সাগর সাগরে যেরূপ পরস্পর প্রতিঘাত হইয়া থাকে, কৌরব ও পাণ্ডবসৈন্যের তদ্রূপ প্রতিঘাত হইতে লাগিল। উভয়পক্ষীয় সেনাগণ হৃষ্টচিত্তে সহস্র শঙ্খ ও ভেরী নিনাদিত করিতে আরম্ভ করিলে সমুদ্রমন্থনসময়ে যেরূপ ঘোরতর শব্দ সমুত্থিত হইয়াছিল, সৈন্যমধ্যে তদ্রূপ অতি ভীষণ শব্দ সমুত্থিত হইল।
অশ্বত্থামার নারায়ণাস্ত্রত্যাগে যুধিষ্ঠিরের ভয়
“হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর অশ্বত্থামা পাণ্ডব ও পাঞ্চালসৈন্যগণকে লক্ষ্য করিয়া নারায়ণাস্ত্রের আবির্ভাব করিলেন। সেই অস্ত্র হইতে দীপ্তাস্য পন্নগের ন্যায় অসংখ্য প্রজ্বলিত শরজাল বিনির্গত হইয়া পাণ্ডবগণকে ব্যাকুলিত করিয়া মুহূৰ্ত্তমধ্যেই দিবাকরকিরণের ন্যায় দিত্মণ্ডল, নভোমণ্ডল ও সেই সেনামণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। লৌহময় বজ্রমুষ্টিসকল গগনমণ্ডলে প্রাদুর্ভূত হইয়া জ্যোতিঃপদার্থের ন্যায় বিচরণ করিতে লাগিল। চতুর্দ্দিকে বিচিত্র শতঘ্নী, বজ্রমুষ্টি, গদা ও সূৰ্য্যমণ্ডলাকার ক্ষুরধার চক্ৰসকল দীপ্তি পাইতে লাগিল। হে মহারাজ! এইরূপে অস্ত্রনিচয়ে গগনমণ্ডল সমাকীর্ণ হইলে, পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ তদ্দর্শনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন, পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ যে যে স্থলে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন, নারায়ণাস্ত্র সেই সেই স্থানে পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল। অনেকে সেই অনলসদৃশ নারায়ণাস্ত্রে বিদ্ধ হইয়া সাতিশয় পীড়িত হইলেন। শিশিরাপগমে হুতাশন যেরূপ শুষ্ক তৃণরাশি দগ্ধ করিয়া থাকে, তদ্রূপ সেই নারায়ণাস্ত্র পাণ্ডবসেনাগণকে বিনষ্ট করিতে লাগিল।
“হে মহারাজ! ঐ সময় ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির অশ্বত্থামার অস্ত্রপ্রভাবে স্বীয় সৈন্যমধ্যে কতকগুলিকে বিনষ্ট, কতকগুলিকে জ্ঞানশুন্য ও কতকগুলিকে ধাবমান এবং অর্জ্জুনকে সমরে উদাসীন অবলোকন করিয়া ভীতচিত্তে কহিলেন, ‘হে ধৃষ্টদ্যুম্ন! তুমি পাঞ্চালসেনাসমভিব্যাহারে পলায়ন কর; হে সাত্যকে! তুমিও বৃষ্ণি ও অন্ধকগণে পরিবৃত হইয়া প্রস্থান কর। ধর্ম্মাত্মা বাসুদেব জনসমূহের উপদেষ্টা। উনি স্বয়ং আপনার পরিত্রাণের উপায় উদ্ভাবন করিয়া লইবেন। হে সৈন্যগণ! আমি তোমাদিগকে কহিতেছি, আর যুদ্ধ কৰ্ত্তব্য নহে। আমি নিশ্চয়ই সোদরগণের সহিত অনলে প্রবেশ করিব। হায়! আমি ভীষ্ম ও দ্রোণরূপ সাগর হইতে সমুত্তীর্ণ হইয়া এক্ষণে দ্রোণপুত্রস্বরূপ গোস্পদে বন্ধুগণের সহিত নিমগ্ন হইলাম। আমি সচ্চরিত্ৰ আচাৰ্য্যকে সংগ্রামে নিপাতিত করিয়াছি বলিয়া ধনঞ্জয় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়াছেন। এক্ষণে তাঁহার অভিলাষ পূর্ণ হউক। রণবিশারদ ক্রূরকর্ম্মা মহারথগণ যখন যুদ্ধানভিজ্ঞ বালক অভিমন্যুকে বিনাশ করেন, তখন যে দ্রোণাচাৰ্য্য তাঁহাকে রক্ষা করেন নাই, দীনভাবাপন্ন সভাগত দ্রৌপদী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে যিনি পুত্রসমভিব্যাহারে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছিলেন, অন্যান্য সমস্ত সৈন্যগণ পরিশ্রান্ত হইলে যিনি অর্জ্জুনজিঘাংসু দুৰ্য্যোধনকে কবচবদ্ধ ও সিন্ধুরাজের রক্ষার্থ নিযুক্ত করিয়াছিলেন, যে ব্রহ্মাস্ত্রবেত্তা আমার জয়াভিলাষী সত্যজিৎপ্রমুখ পাঞ্চালগণকে সমূলে উন্মূলিত করিয়াছেন এবং কৌরবগণ অধর্ম্মপূর্ব্বক আমাদিগকে রাজ্য হইতে নিৰ্ব্বাসিত করিলে যিনি আমাদিগকে যুদ্ধ করিতে নিবারিত করিয়াছিলেন, আমাদের সেই পরমসুহৃৎ দ্রোণাচাৰ্য্য নিহত হইয়াছেন; এক্ষণে আমিও বান্ধবগণের সহিত নিহত হইব।’
অস্ত্রপরিত্যাগে কৃষ্ণের পরামর্শ—ভীমের অনিচ্ছা
“হে মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির এইরূপ কহিলে পর মহাত্মা বাসুদেব বাহুসঙ্কেতদ্বারা পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যগণকে নিবারণ করিয়া কহিলেন, ‘হে যোধগণ! তোমরা নিরায়ুধ ও ভূতলে অবতীর্ণ হইলে এ অস্ত্র আর আমাদিগকে বিনাশ করিতে সমর্থ হইবে না। অস্ত্রের প্রতিঘাত করিবার এইমাত্র উপায় আছে। যে যে স্থানে শনিবারণাৰ্থ বা অস্ত্রবলনিরাকরণার্থ যুদ্ধ করিবে, সেই সেই স্থানে কৌরবেরা অতি ভীষণ হইয়া উঠিবে। আর যাহারা অস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া বাহন হইতে অবতীর্ণ হইবে, তাহারা কখনই এ অস্ত্রে বিনষ্ট হইবে না। যুদ্ধকাৰ্য্যে আহূত হওয়া দূরে থাক্, যাঁহারা যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত চিন্তা করিবেন, তাঁহারা রসাতলে প্রবেশ করিলেও এই অস্ত্র তাঁহাদিগকে নিহত করিবে।’ হে মহারাজ! পাণ্ডবপক্ষীয়েরা বাসুদেবের বাক্য শ্রবণ করিয়া সকলেই অস্ত্র ও যুদ্ধচিন্তা পরিত্যাগ করিতে বাসনা করিল।
“তখন মহাবীর ভীমসেন যোধগণকে অস্ত্রপরিত্যাগে উদ্যত অবলোকন করিয়া তাহাদিগকে আহ্লাদিত করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে যোধগণ! তোমরা কদাচ অস্ত্র পরিত্যাগ করিও না। আমি শরনিকরনিপাতে অশ্বত্থামার অস্ত্র নিবারণ করিতেছি। আমি এই সুবর্ণময়ী গুৰ্ব্বী গদা সমুদ্যত করিয়া দ্রোণপুত্রের নারায়ণাস্ত্র বিমর্পিত করিয়া অন্তকের ন্যায় রণস্থলে বিচরণ করিব। এই ভূমণ্ডলমধ্যে যেমন কোন জ্যোতিঃপদার্থই সূৰ্য্যের সদৃশ নহে, তদ্রূপ আমার তুল্য পরাক্রমশালী আর কোন মনুষ্যই নাই। আমার এই যে ঐরাবতসদৃশ সুদৃঢ় ভুজদণ্ড অবলোকন করিতেছ, ইহা হিমালয়পর্ব্বতেরও নিপাতনে সমর্থ। আমি অযুত নাগতুল্য বলশালী; দেবলোকে পুরন্দর যেমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, নরলোকমধ্যে আমিও তদ্রূপ আজ আমি দ্রোণপুত্রের অস্ত্রনিবারণে প্রবৃত্ত হইতেছি, সকলে আমার বাহুবীৰ্য্য অবলোকন করুন। যদি কেহ এই নারায়ণাস্ত্রের প্রতিযোদ্ধা বিদ্যমান না থাকে, তাহা হইলে আমি স্বয়ং কৌরব ও পাণ্ডবগণের সমক্ষে অস্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হইব। হে অর্জ্জুন! তুমি গাণ্ডীবধনু পরিত্যাগ করিও না, তাহা হইলে তোমার কোপ শিথিলিত হইবে। অর্জ্জুন ভীমের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে মহাবীর! নারায়ণাস্ত্র, গো ও ব্রাহ্মণের বিপক্ষে আমি গাণ্ডীব ধারণ করি না, ইহা আমার উৎকৃষ্ট নিয়ম। শরনিসূদন ভীমসেন অর্জ্জুনের বাক্যশ্রবণানন্তর সূৰ্য্যের ন্যায় তেজঃসম্পন্ন মেঘগম্ভীর নিঃস্বন স্যন্দনে আরোহণপূর্ব্বক দ্রোণপুত্রের প্রতি ধাবমান হইয়া লঘুহস্ততা প্রদর্শন করিয়া নিমেষমধ্যে তাঁহাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা তদ্দর্শনে হাস্য করিয়া প্রদীপ্তা মন্ত্রপূত শরজালে ভীমসেনকে আবৃত করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর বৃকোদর সেই কাঞ্চনস্ফুলিঙ্গসদৃশ দীপ্তাস্য ভুজতুল্য প্রজ্বলিত মর্ম্মভেদী শরসমূহে সমাকীর্ণ হইয়া রজনীযোগে খদ্যোতপরিবেষ্টিত পর্ব্বতের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। অশ্বত্থামার সেই ভীষণ অস্ত্র তাঁহার প্রতি অর্পিত হইয়া অনিলোদ্ধূত [বায়ুযোগে পরিবর্দ্ধিত] অগ্নির ন্যায় পরিবর্দ্ধিত হইয়া উঠিল। তখন ভীমসেন ভিন্ন আর সমুদয় পাণ্ডবসৈন্য নিতান্ত ভীত হইয়া অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক সকলে রথ ও অশ্ব হইতে ক্ষিতিতলে অবতীর্ণ হইতে লাগিল। তাঁহারা সকলে ন্যস্তায়ুধ [ত্যক্ত অস্ত্র] ও বাহন হইতে অবতীর্ণ হইলে সেই বিপুলবীৰ্য্য ভীষণ অস্ত্র ভীমসেনের মস্তকে পতিত হইল। তখন প্রাণীগণ ও বিশেষতঃ পাণ্ডবেরা ভীমসেনকে তেজোদ্বারা পরিবৃত দেখিয়া হাহাকার করিতে লাগিলেন।