২০০তম অধ্যায়
ধুন্ধুমার উপাখ্যান-বৰ্ণন
বৈশম্পয়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির মহাভাগ মার্কণ্ডেয়ের নিকট রাজর্ষি ইন্দ্ৰদ্যুম্নের স্বৰ্গপ্রাপ্তিবৃত্তান্ত শ্রবণানন্তর জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে ধর্ম্মজ্ঞ! আপনি দেব, দানব, রাক্ষস, বিবিধ রাজবংশ, সনাতন ঋষিবংশ, মনুষ্য, উরাগ, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, কিন্নর ও অপ্সরাগণের দিব্য-উপাখ্যান অবগত আছেন; এই জগতীতলে কিছুই আপনার অবিদিত নাই, অতএব ইক্ষ্বাকুবংশীয় কুবলাশ্ব-ভূপতি কি প্রকারে স্বনামের পরিবর্তে ধুন্ধুমার সংজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, আমি সেই বৃত্তান্ত শ্রবণ করিবার নিমিত্ত এক্ষণে নিতান্ত সমুৎসুক হইয়াছি।”
মহামুনি মার্কণ্ডেয় ধর্ম্মরাজের প্রশ্ন শ্রবণ করিয়া ধুন্ধুমারের উপাখ্যান কহিতে আরম্ভ করিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! উতঙ্কনামে এক সুপ্ৰসিদ্ধ মহর্ষি ছিলেন; রমণীয় মরুধন্ব-প্রদেশে তাঁহার আশ্রম। তিনি ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা করিবার নিমিত্ত বহু বৎসর দুশ্চর তপশ্চৰ্য্যা করিয়াছিলেন। ভগবান বিষ্ণু সাতিশয় প্রীত হইয়া তাঁহার নয়নপথে আবির্ভূত হইলেন।
“মহর্ষি উতঙ্ক তাঁদের দর্শন করিবামাত্র অতিমাত্র বিনীতভাবে স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন, “হে দেব! তুমি সুরাসুর, মানব প্রভৃতি সমুদয় চরাচর, ব্ৰহ্ম, বেদ ও বেদ্য সৃষ্টি করিয়াছ। আকাশ তোমার মস্তক, চন্দ্ৰ-সূৰ্য্য দুই নয়ন, সমীরণ নিঃশ্বাস, হুতাশন তেজ, দিকসকল বাহু, মহার্ণব কুক্ষি, পর্ব্বত-সকল উরু, অন্তরীক্ষ জঙ্ঘা, পৃথিবী চরণ এবং ওষধি-সকল রোম। ইন্দ্ৰ, চন্দ্ৰ, অগ্নি, বরুণ প্রভৃতি দেবতা, অসুর, মহোরগ ও মহাযোগী মহর্ষিগণ বিনীত হইয়া বিবিধবাক্যে তোমার স্তব করিয়া থাকেন। হে ভুবনেশ্বর! তুমি সমুদয় চরাচর ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছ, তুমি পরিতুষ্ট থাকিলে সমুদয় জগৎ সুস্থ থাকে, তুমি রুষ্ট হইলে মহদ্ভয় উপস্থিত হয়। হে পুরুষোত্তম! তুমিই একমাত্র ভয়াপহারক ও দেব, মানব প্রভৃতি সর্ব্বভূতের সুখদাতা। হে দেব! তুমি ত্ৰিবিধ বিক্রমদ্বারা লোকত্ৰয় সংহার ও সমৃদ্ধ দানবদলকে বিনাশ করিয়াছিলে। দেবগণ তোমারই বিক্রমে নির্ব্বাণপদ প্রাপ্ত হইয়াছেন। হে ভূতভাবন! তুমিই ক্রুদ্ধ হইয়া দৈত্যেন্দ্রগণকে পরাভূত করিয়াছ, তুমিই ভূতগণের কর্ত্তা ও সংহর্ত্তা। দেবগণ তোমাকে আরাধনা করিয়াই সর্ব্বপ্রকার সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করিয়াছেন।”
“হৃষীকেশ মহাত্মা উতঙ্কের স্তবে পরিতুষ্ট হইয়া কহিলেন, “আমি প্রীত হইয়াছি, তুমি বর প্রার্থনা কর।”
“উতঙ্ক কহিলেন, “দেব! তুমি সনাতন পুরুষ ও জগতের স্রষ্টা, আমি যখন তোমাকে দর্শন করিয়াছি, তখন আমার আর কোন বর অবশিষ্ট আছে?”
“বিষ্ণু কহিলেন, “আমি তোমার ধৈৰ্য্য ও ভক্তিগণে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি, অতএব অবশ্যই তোমাকে বর গ্রহণ করিতে হইবে।
“মাহাত্মা উতঙ্ক বরদানের নিমিত্ত শ্রীহরির নির্ব্বন্ধাতিশয় সন্দর্শন করিয়া অঞ্জলিবন্ধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভগবন। রাজীবলোচন! যদি আমার প্রতি প্রীত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে এই বর প্রদান করুন যে, আমার বুদ্ধি যেন সত্য, ধর্ম্ম ও ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহে নিয়ত নিযুক্ত থাকে, এবং ভক্তিদ্বারা নিত্য নিত্য যেন আপনার সন্নিহিত হইতে পারি।”
“বিষ্ণু কহিলেন, ‘হে দ্বিজ! আমার প্রসাদে তোমার সমুদয় কামনা পরিপূর্ণ হইবে। তোমার যোগ এরূপ দীপ্যমান হইবে যে, তুমি তদ্বারা লোকত্ৰয় ও দেবগণের অসামান্য উপকার-সাধন করিবে। হে দ্বিজ! ধুন্ধুনামা এক মহাসুর লোকত্ৰয়ের উৎসাদনার্থ ঘোরতর তপশ্চৰ্য্যা করিবে। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা বৃহদশ্বের পুত্ৰ জিতেন্দ্ৰিয় অতি-পবিত্ৰ কুবলাশ্ব মদীয় যোগবল অবলম্বনপূর্ব্বক তোমারই শাসনে তাহাকে বিনষ্ট করিয়া ধুন্ধুমার-নাম প্রাপ্ত হইবে।’ ভূতভাবন ভগবান বিষ্ণু ইহা কহিয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন।”