স্বর্গারোহণিকপর্ব্বাধ্যায়
নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।
জনমেজয় কহিলেন, ব্রহ্মন্! আপনি অদ্ভুতকৰ্ম্মা মহর্ষি বেদব্যাসের শিষ্য; আপনার অবিদিত কিছুই নাই; অতএব আমার পূর্ব্বপিতামহ পাণ্ডবগণ এবং ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ স্বর্গলাভ করিয়া কে কোন স্থানে অবস্থান করিতে লাগিলেন, তাহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত বাসনা হইয়াছে, আপনি তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।
দুৰ্য্যোধনসহ একত্র বাসে যুধিষ্ঠিরের অনিচ্ছা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! আপনার পূৰ্ব্বপিতামহগণ স্বর্গলাভ করিবার পর যেরূপ কাৰ্য্য করিয়াছিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির স্বর্গে গমন করিয়া দেখিলেন, মহারাজ দুর্য্যোধন সাধ্য ও দেবগণে পরিবেষ্টিত হইয়া প্রভামণ্ডলসম্পন্ন মার্ত্তণ্ডের ন্যায় শোভা ধারণপূৰ্ব্বক আসনে সমাসীন রহিয়াছেন। তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র যুধিষ্ঠিরের ক্রোধের আর পরিসীমা রহিল না। তখন তিনি তথা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া দেবগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে সুরগণ! যে লোভাকৃষ্টচিত্ত দুরাত্মা দুর্য্যোধনের নিমিত্ত আমরা পৃথিবী উৎসন্ন ও বন্ধুবান্ধবগণকে যুদ্ধে নিহত করিয়াছি, যাহার নিমিত্ত আমাদিগকে বনমধ্যে অশেষবিধ কষ্টভোগ করিতে হইয়াছে এবং যে দুরাত্মা সভামধ্যে গুরুজনসমক্ষে আমাদিগের সহধর্ম্মিণী ধৰ্ম্মচারিণী দ্রৌপদীর কেশম্বরাকর্ষণ করিয়াছে, সেই দুরাত্মার সহিত স্বর্গলোকে অবস্থান করতে আমার কিছুমাত্র বাসনা নাই, আর আমি উহার মুখদর্শন করিব না। এক্ষণে যে স্থলে আমার ভ্রাতৃগণ অবস্থান করিতেছে, আমি সেই স্থানেই গমন করিব।”
বিদ্বেষবুদ্ধিত্যাগে দেবর্ষি নারদের উপদেশ
ধর্ম্মরাজ এই কথা কহিলে, দেবর্ষি নারদ হাস্যবদনে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ধৰ্ম্মনন্দন! অমন কথা কহিও না। স্বর্গে অবস্থান করিলে অন্যের সহিত বিরোধ থাকে না। দুৰ্য্যোধনের প্রতি ওরূপ বাক্য প্রয়োগ করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। যেসক নরপতি স্বর্গে অবস্থান করিতেছেন, তাঁহারা এবং দেবগণ সকলেই দুর্য্যোধনের সৎকার করিয়া থাকেন। উনি সর্ব্বদা তোমাদিগকে হিংসা করিতেন বটে, কিন্তু ঐ মহাত্মা এক্ষণে ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে সমরাঙ্গনে স্বীয় কলেবর পরিত্যাগ করিয়া বীরজনোচিত সদ্গতি লাভ করিয়াছেন। উনি পূৰ্ব্বে মহাভয়ের সময় উপস্থিত হইলেও ভীত হয়েন নাই। উঁহার সেই পুণ্যবলে এই সম্পত্তিলাভ হইয়াছে। যাহা হউক, অতঃপর তোমার দ্যূতপরাজয়, দ্রৌপদীর কেশাম্বরাকর্ষণ, যুদ্ধ ও অন্যান্য ক্লেশসমুদয় স্মরণ করা কর্ত্তব্য নহে। এক্ষণে তুমি রাজা দুর্য্যোধনের সহিত সুহৃদ্ভাবে সঙ্গত হও। এ স্বর্গভূমি, এ স্থলে বৈরভাব অবলম্বন করা উচিত নহে।”
দেবর্ষি নারদ এই কথা কহিলে, রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “দেবর্ষে! যে দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের নিমিত্ত মনুষ্য ও হস্তী, অশ্ব প্রভৃতি প্রাণীগণের সহিত পৃথিবী উৎসন্নপ্রায় হইয়াছে, যাহার বৈরনির্য্যাতনার্থ আমরা কোপানলে দগ্ধ হইয়াছি, যদি সেই দুরাত্মার সনাতন বীরলোকলাভ হইল, তাহা হইলে আমার সত্যপ্রতিজ্ঞ প্রবলপরাক্রম সত্যবাদী ভ্রাতৃগণ কোন্ স্থানে অবস্থান করিতেছেন? কুন্তীতনয় মহাবীর কর্ণের কোন লোক লাভ হইয়াছে? ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নের তনয়গণ কোন স্থানে অবস্থান করিতেছেন? বিরাট, দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, শিখণ্ডী, পাঞ্চালরাজ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ ও অভিমন্যু প্রভৃতি বীরগণ কোন্ লোক লাভ করিয়াছেন এবং অন্যান্য যেসমুদয় নরপতি ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে সমরে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহারাই বা এক্ষণে কোথায় রহিয়াছেন? আপনি তাহা কীৰ্ত্তন করুন! ঐ সকল বীরের সহিত সাক্ষাৎকার করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে।”