১৯তম অধ্যায়
পূর্বোক্ত পরিখেদে দ্ৰৌপদীর পুনঃ পরিতাপ
দ্ৰৌপদী কহিলেন, “নাথ! আমি অসূয়া প্রকাশ করিতেছি না; যৎপরোনাস্তি দুঃখভোগ করিতেছি বলিয়াই কহিতেছি। তুমি অতি হেয় সূপকারকর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া বল্লভ বলিয়াই আত্মপরিচয় প্রদান করিতেছ; ইহা দেখিয়া কাহার শোকসাগর উচ্ছলিত না হয়? লোকে তোমাকে বিরাটের সূপকার বল্লভ বলিয়া নিশ্চয় করিয়াছে; তুমি দাসবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছ; ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি আছে? অন্ন-ব্যঞ্জন প্রস্তুত হইলে, যখন তুমি বিরাটের উপাসনা করিতে যাও, তখন আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়! যখন সম্রাট সন্তুষ্ট হইয়া তোমাকে কুঞ্জরগণের সহিত যুদ্ধে প্রবর্ত্তিত করেন, তখন অন্তঃপুরস্থ সমুদয় নারীগণ হাস্য করিতে থাকে; তদর্শনে আমার অন্তঃকরণ আকুলিত হইয়া উঠে। যখন তুমি অন্তঃপুরে সুদেষ্ণার সমক্ষে শার্দ্দুল, মহিষ ও সিংহগণের সহিত সংগ্রাম করিতেছিলে, আমি তখন শোকাবেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া মোহাবিষ্ট হইয়াছিলাম। সুদেষ্ণা আমাকে মোহাভিভূতা নিরীক্ষণ করিয়া উত্থাপনপূর্ব্বক সমাগত রমণীগণের সমক্ষে কহিতে লাগিলেন, “সূপকার প্রবলপরাক্রান্ত জন্তুগণের সহিত যুদ্ধ করিতেছে দেখিয়া চারুহাসিনী সৈরিন্ধ্রী সহবাসসুলভ স্নেহে শোকাভিভূত হইয়াছে। সৈরিন্ধ্রী অতিশয় রূপবতী, বল্লভ পরমসুন্দর এবং স্ত্রীলোকের চিত্তবৃত্তিও দুর্জ্ঞেয়; ইহারা উভয়েই এক সময়ে রাজকুলে আশ্রয়গ্ৰহণ করিয়াছে। বিশেষতঃ সৈরিন্ধ্রী সর্ব্বদাই প্রিয়-সহবাসের নিমিত্ত পরিতাপ করিয়া থাকে।” হে মহাবাহো! রাজমহিষী এই প্রকার স্বাভিপ্রেত বাক্যে সর্ব্বদাই আমাকে তর্জন করিয়া থাকেন; আমি তাহাতে রোষ-প্রদর্শন করিলে তিনি সমধিক সন্দিহান হয়েন। আমি তন্নিবন্ধন নিতান্ত দুঃখিত হইয়াছি। তুমি তাদৃশ পরাক্রমশালী হইয়াও যখন ঈদৃশ নিরয়াভোগী হইয়াছ এবং ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির শোকসাগরে নিমগ্ন হইয়াছেন, তখন আমি ইহা সন্দর্শন করিয়া আর জীবনধারণ করিতে পারি না।
“যে যুবা এক-রথে সমস্ত দেব ও মনুষ্যগণকে পরাজিত করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনি বিরাটরাজের কন্যাগণের নর্ত্তক হইয়াছেন। যিনি স্বীয় প্রভাবে খাণ্ডবারণ্যে হুতাশনকে পরিতৃপ্ত করিয়াছিলেন, তিনি এক্ষণে কৃপগত অগ্নির ন্যায় অন্তঃপুরে সংবৃত হইয়া বাস করিতেছেন। আরাতিগণ যাঁহার ভয়ে সতত ভীত হইয়া থাকে, তিনি এক্ষণে অতি ঘৃণিত বেশে কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন। যাঁহার পরিঘসদৃশ বাহুদ্বয় মৌর্ব্বৗ-আস্ফালনে সাতিশয় কঠিন হইয়াছে, তিনি এক্ষণে সেই বাহুদ্বয় শঙ্খাবৃত করিয়া রাখিলেন, ইহা অপেক্ষা শোচনীয় ব্যাপার। আর কি হইতে পারে? শত্রুগণ যাঁহার জ্যানির্ঘোষ শ্রবণমাত্ৰেই কম্পিত হইয়া উঠে, এক্ষণে স্ত্রীগণ হৃষ্টচিত্তে তাঁহার গীতধ্বনি শ্রবণ করিতেছে। যাঁহার মস্তক সূর্য্যসদৃশ কিরীটে সুশোভিত হইত, আজি তাহা বেণীদ্বারা বিকৃত হইয়া রহিল। হে নাথ! ধনঞ্জয়কে বিকৃতবেণী ও কন্যাগণে পরিবৃত দেখিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে! যে মহাত্মা সমস্ত দিব্যাস্ত্রের ও সমুদয় বিদ্যার আধার, তিনি এক্ষণে কুণ্ডল ধারণ করিতেছেন। মহাবলপরাক্রান্ত সহস্ৰ সহস্র রাজা সমরে যাঁহার সম্মুখীন হইতে পারিতেন না, এক্ষণে তিনি ছদ্মবেশে বিরাটরাজের কন্যাগণের নর্ত্তক হইয়া তাঁহাদিগের পরিচর্য্যা করিতেছেন। যাঁহার রথনির্ঘোষে সচরাচর ধরাতল বিকম্পিত হইত, যিনি জন্ম পরিগ্ৰহ করিলে কুন্তীর সমুদয় শোকসন্তাপ অপনোদিত হইয়াছিল, এক্ষণে তাঁহাকে কুণ্ডল ও শঙ্খাদি অলঙ্কার ধারণ করিতে দেখিয়া একান্ত শোকাকুল হইয়াছি। ধরাতলে, যাঁহার সমকক্ষ ধনুর্দ্ধর নাই, আজি তাঁহাকে কন্যাগণের নিকট গান করিয়া কালব্যাপন করিতে হইল! যিনি ধর্ম্ম, শৌৰ্য্য ও সত্যদ্বারা সমস্ত জীবলোকের প্রতিভাজন হইয়াছিলেন, আজি তাঁহাকে স্ত্রীবেশবিকৃত নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত কাতর হইয়াছি। যখন আমি সেই দেবরূপী ধনঞ্জয়কে করেণুপরিবৃত মত্ত-মাতঙ্গের ন্যায় কন্যাগণ-পরিবৃত ও তুৰ্য্যমধ্যস্থ হইয়া বিরাটরাজের উপাসনা করিতে দেখি, তখন আমার দশদিক শূন্য হইয়া যায়। হায়! মহাবীর ধনঞ্জয় ও দৃঢ়তাসক্ত অজাতশত্রু যে ঈদৃশ বিপত্তিসাগরে নিমগ্ন হইয়াছেন, আৰ্য্যা কুন্তী ইহার কিছুই জানিতেছেন না।
“হে বৃকোদর! আমি যবীয়ান সহদেবকে গোমধ্যে গোপালবেশে বিচরণ করিতে দেখিয়াই পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া গিয়াছি। আমি শান্তিলাভ করিব কি, পুনঃ পুনঃ সহদেবের বৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া একেবারে আমার নিদ্রাচ্ছেদ [অনিদ্রা–নিদ্র বন্ধ] হইয়াছে। আমি সত্যবিক্রম সহদেবের এমন কোন পাপই দেখিতে পাই না, যাহাতে তাঁহাকে ঈদৃশ দুঃখভোগ করিতে হয়। আমি তোমার প্ৰিয়তম ভ্রাতাকে গোচারণে নিযুক্ত দেখিয়া নিতান্ত শোকাকুল হইয়াছি। বিরাট কুপিত হইলে যখন তিনি লোহিত পরিচ্ছদ ধারণপূর্ব্বক গোপালগণের অগ্ৰে অগ্ৰে গমন করিয়া বিরাট-নৃপতিকে প্রসন্ন করেন, তখন আমার কলেবর জর্জরিত হয়। আৰ্য্যা কুন্তী আমার নিকট মহাবীর সহদেবের প্রশংসা করিতেন। যখন আমরা রাজ্য হইতে নির্ব্বাসিত হই, তৎকালে তিনি আমাকে কহিয়াছিলেন, ‘বৎসে পঞ্চালি! সুকুমার সহদেব সাতিশয় সুশীল, লজ্জাশীল, যুধিষ্ঠিরের একান্ত অনুগত, তুমি অতি সাবধানে অরণ্যমধ্যে ইহাকে রক্ষণাবেক্ষণ ও স্বয়ং পান-ভোজন প্ৰদান করিবে।” পুত্রবৎসলা আৰ্য্যা এই বলিয়া রোদন করিতে করিতে সহদেবকে আলিঙ্গন করিয়া রহিলেন। হায়! এক্ষণে সেই সহদেবকে গোচরণ ও বৎসচার্ম্মে শয়ান হইয়া রাত্রিযাপন করিতে দেখিয়া আমি কিরূপে প্ৰাণধারণ করিতে পারি?
‘কালের বৈপরীত্য দেখ। যিনি রূপ, অস্ত্র ও মেধাসম্পন্ন, সেই নকুল এক্ষণে অশ্ববন্ধ হইয়াছেন! তিনি যখন বিরাটরাজের সমক্ষে অশ্বগণকে বেগশিক্ষা দেন, তখন দর্শকগণ চতুর্দ্দিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে। আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি, শ্ৰীমান নকুল এই প্রকারে বিরাটরাজকে অশ্ব-প্রদানপূর্ব্বক উপাসনা করেন।
“হে বৃকোদর! যুধিষ্ঠিরের নিমিত্ত আমার এই প্রকার কত শত দুঃখ বিদ্যমান থাকিতেও তুমি কি প্রকারে আমাকে সুখিনী বলিয়া বিবেচনা করিতেছ? ইহা ভিন্ন আর যে-সকল দুঃখ বলিতে অবশিষ্ট আছে, তাহাও বলিব, শ্রবণ কর। তোমরা জীবিত থাকিতে দুঃখরাশি আমার শরীর শোষণ করিতেছে, উহা অপেক্ষা অধিক দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে?”