[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১৯. আমি কেন ফিরে যাব

আমি কেন ফিরে যাব, বলতে পারেন?

যুবকটির তীব্র প্রশ্ন শুনে আমি খানিকটা কাঁচুমাচু হয়ে যাই। এই সব কঠিন প্রশ্ন আমাকে জিগ্যেস করবার কোনও মানে হয়? কে দেশে ফিরে যাবে, কে অন্য দেশে থেকে জীবনে উন্নতি করবে, তার আমি কি জানি। ও সব তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আমি অন্যদের সাতে পাঁচে থাকতে চাইনা।

তবু যুবকটি আমার কাছে ঘুরে আসছিল বারবার। বিশাল পার্টি, অন্তত শ’ খানেক নারী-পুরুষ তো হবেই। এর মধ্যে কুড়ি পঁচিশ জনের মাত্র বসবার জায়গা আছে, বাকি সবাই দাঁড়িয়ে। আমেরিকান পার্টির মতন ভয়াবহ জিনিস আর নেই। এক সঙ্গে এত মানুষ, সুতরাং সকলের সঙ্গেই সঠিক চেনা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তবু এসব জায়গায় একটা অলিখিত নিয়ম আছে, প্রত্যেকের সঙ্গেই ঘুরে-ঘুরে কথা বলতে হবে, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। সে এক হৃদয়হীন ব্যাপার। একজন এসে প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে খুবই আন্তরিক গলায় জিগ্যেস করবে, তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ, সেখানকার আবহাওয়া কীরকম, তোমাদের ভাষা সমস্যার কীভাবে সমাধান করো, ইত্যাদি। মনে হবে যেন, এইসব বিষয় জানবার জন্য তার কত না আগ্রহ। কিন্তু ঠিক পাঁচ-ছ’মিনিট পরে হঠাৎ ‘এক্সকিউজ মি’ বলে পট করে মুখ ঘুরিয়ে আর একজনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দেবে। আর আমাকে চিনতেই পারবে না। এই রকম একের পর এক।

সেই জন্যই, বাধ্য হয়ে কখনও এই সব পার্টিতে যেতে হলে আমি প্রথমেই জায়গা বেছে নিয়ে এক কোণে বসে থাকি, কেউ কাছে এসে কথা বললে তো বলল, কেউ কথা না বললেও আমার জীবনের কোনও ক্ষতি হয় না।

এই পার্টিতে অবশ্য জনা আষ্টেক ভারতীয়ও আছে। শুধু ভারতীয় কজন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জটলা করলে ভালো দেখায় না বলে তারাও আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আমি যথারীতি জানলার ধারে একটা কাঠের টুল নিয়ে আসন গেড়ে বসে উত্তম-উত্তম পানীয়ের সদব্যবহার করছি। কারুকে আমার দিকে আসতে দেখলেই চট করে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি জানলার বাইরে। একেই তো ইংরেজি বলতে-বলতে চোয়াল ব্যথা হয়ে যায়, তাতে প্রত্যেকের সঙ্গে একই ধরনের কথা বলারও কোনও মানে হয় না।

এই বাঙালি যুবকটি কিন্তু বারবার ধেয়ে আসছে আমার দিকে।

বছরতিরিশেক বয়েস, বেশ স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ, চোখ দুটিতে বুদ্ধি ও মেধার চিহ্ন আছে। সঙ্গে তার স্ত্রী, সেও বেশ সুন্দরী, কথাবার্তা খুব নরম ধরনের। মেয়েটি প্রথমে আমাকে চিনতে পারে। আমার ছোট মাসির মেয়ে টুলটুল ওর বান্ধবী, সেই সূত্রে কয়েকবার আমায় কলকাতায় দেখেছে। এবং, কী আশ্চর্য ব্যাপার, সে নীললোহিতের লেখাটেখাও পড়েছে দু-একটা। সুতরাং সে একটু উচ্ছ্বাস দেখাল।

তার স্বামী কিন্তু উচ্ছাস-টুচ্ছ্বাসের ধার ধারে না। নীললোহিত-ফিললোহিত বলে কারুর নামও সে শোনেনি। আমি টাটকা কলকাতা থেকে এসেছি, এটাই আকৃষ্ট করল তাকে।

প্রথম আলাপেই ভদ্রলোক বক্রকণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, কলকাতাটা সেই একই রকম নরক হয়েই আছে? সেই লোডশেডিং, সেই রাস্তায় ঘাটে নোংরা…

আমি হেসে বললুম, আপনি শেষ কবে কলকাতা দেখেছেন?

–সেই নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ানে।

–তা হলে বিশেষ কিছু বদলেছে বলে মনে হয় না। তবে হাওড়া ব্রিজের কাছে ফ্লাই ওভার হয়ে গেছে, শিয়ালদারটাও শিগগির খুলবে শুনে এসেছি…আর হাওড়ার সাবওয়ে কি আপনারা দেখেছিলেন?

–বুল শিট! ওসব কে শুনতে চাইছে? মানুষের অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে? কলকাতার রাস্তায় একটা লোক মরে পড়ে থাকলে তাকে সরাতে ক’ঘন্টা লাগে? টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স? ফরটি এইট?

সত্যি কথা বলতে কী আমি কলকাতার রাস্তায় কোনওদিন কোনও মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখিনি। এরকম হয় জানি, কিন্তু আমার চোখ দুটি ভাগ্যবান, এরকম দৃশ্য কোনওদিন সহ্য করতে হয়নি। একদিন দুপুরে শুধু মেট্রোপলিটান বিল্ডিং-এর সামনে একজন লোককে শুয়ে থাকতে দেখেছিলুম, তার মুখের ওপর মাছি উড়ছিল। কাছে গিয়ে দেখেছিলুম সে আসলে একটি অজ্ঞান মাতাল। সেটা কৌতুক দৃশ্য, করুণ কিছু ব্যাপার নয়।

সুতরাং চুপ করে রইলুম।

–কলকাতার মতন একটা এত বড় মেট্রোপলিস, অথচ এখনও সেখানে রাস্তায় লোক পড়ে থাকে, না খেয়ে মানুষ মরে, তার চেয়েও খারাপ আধমরা হয়ে লাখ লাখ লোক বেঁচে থাকে…পৃথিবীর আর কোনও দেশ…ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর…এই সব মাইনর কান্ট্রিজেও এখন এরকম অবস্থা নেই। চিনের কথা তো বাদই দিলুম।

–তা আপনি ঠিকই বলেছেন।

–কেন, কেন এরকম হয়? তার কারণ, পলিটিক্যাল পার্টিগুলো…ওদের কোনও ইডিয়লজিই নেই…দেশের কথা কেউ ভাবে না…শুধু বড় বড় কথা বলে, সব ফালতু বাত!

গলার আওয়াজ শুনেই বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোকের পেটে এর মধ্যেই গেলাস চারেক হুইস্কি চলে গেছে। এই রকম সময় অনেকের মনেই আদর্শবাদ জেগে ওঠে। দেশের কথা মনে পড়ে। তা পড়ুক। কিন্তু উনি এমনভাবে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে কথা বলছেন, যেন এইসব দুরবস্থার জন্য আমিই দায়ী।

ভদ্রলোকের স্ত্রী একটু অপ্রস্তুত হয়ে স্বামীকে ফিসফিস করে কী যেন বললেন।

ভদ্রলোক তবু তেড়িয়া হয়ে বললেন, আর কলকাতার টেলিফোন! সেই বর্বর যুগেই আছে না। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে…আর দু-মাস টেলিফোন ডেড থাকলেও সাতশো টাকা বিল। আপনারা মশাই মহা ইডিয়েট, যে যার বাড়ির রিসিভারগুলো বাড়ির সামনের রাস্তায় আছড়ে ভেঙে ফেলতে পারেন না?

ভদ্রমহিলা এবার স্বামীর জামা ধরে বললেন, এই, তোমাকে মিসেস ওয়াল্টার্স ডাকছেন বললুম না। চলো–

প্রায় টানতে-টানতে তিনি নিয়ে চলে গেলেন স্বামীকে।

কিন্তু দশ মিনিট বাদেই যুবকটি আবার ফিরে এলেন। হাতে আর একটি ভরা গেলাস। চোখ লালচে, মাথার চুল খাড়া হতে শুরু করেছে।

আমাকে ভালো করে দেখে নিয়ে আবার কড়া গলায় জিগ্যেস করলেন, শিবপুর না যাদবপুর?

এই রে, ভদ্রলোক আমাকে প্রথম থেকেই স্বজাতি বলে ভুল করেছেন। প্রবাসে বাঙালি দেখলে চোখকান বুজেই বলে দেওয়া যায় ইঞ্জিনিয়ার। একশো জনের মধ্যে অন্তত আশিজন তো বটেই। আর বাকিরা ডাক্তার কিংবা শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত।

আমি জানালুম যে, আমি ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার নই।

–তবে প্রেসিডেন্সির ছাত্র?

–‘আজ্ঞে না। আমি ইস্কুল ফাইনালই পাশ করেছি তিনবারের চেষ্টায়, তারপর কোনও ক্রমে একটা মফসসল কলেজে…

–স্টেটসে এসেছেন কেন?

–এই…বলতে পারেন…বেড়াতে।

–টুরিস্ট!

এমন একটা ধিক্কারের সঙ্গে বললেন কথাটা, যেন আমি একটা কেঁচো কিংবা আরশোলা। তারপর আবার যোগ করলেন, বাপের অনেক পয়সা আছে বুঝি?

আমি বললুম, আপনার মতন কোনও বড়লোক বন্ধু এদেশ থেকে তো টিকিট পাঠিয়ে দিতেও পারে। তারপর স্রোতের ফুলের মতন এখানে ওখানে ভেসে বেড়ানো।

মুখের ভাব না বলেই তিনি বললেন, হ্যাঁ, অনেকেই এরকম টিকিট চায় বটে। আমি দু-বছর আগে আমার এক মামার জন্য টিকিট পাঠিয়ে ছিলুম। আমার বাবা-মাও এসে ঘুরে গেছেন একবার। আমার স্ত্রী…ওর তো প্রত্যেক দু-বছর অন্তর দেশে যাওয়া চাই-ই। গতবার ওর বোনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরেছিল। এই ক্যাপিটালিস্ট দেশে আপনারা কী দেখতে আসেন? কতকগুলো বড় বড় বাড়ি আর রাস্তাঘাট, আর ফরসা-ফরসা মেয়েছেলে…দেশ থেকে অনেকে এসে যা পায় গপগপ করে খেয়ে নিয়ে যায়…যত সব হ্যাংলা, বুভুক্ষু পার্টি।

মাতালের ওপর রাগ করা নিয়মবিরুদ্ধ তাই আমি চুপ করে মিটিমিটি হাসতে লাগলুম।

প্রবাসে বাঙালিরা প্রায় সবাই খুবই পরিমিত মদ্যপায়ী। সকলের বাড়িতেই ওসব জিনিসপত্তর মজুত থাকে, কিন্তু নিজেরা এক-দু-ঢোঁকের বেশি খান না। একেবারে টিটোটালারও অনেক দেখা যায়। বিশেষত পার্টিতে মাতাল হওয়া একেবারেই নিয়মবিরুদ্ধ, তাই সেরকম অবস্থায় কোনও বাঙালিকে চিৎ দেখা যায়। এই যুবকটি যে একটু বেশি পান করে ফেলেছেন, তার কারণ বোধ হয় ওঁর মনের মধ্যে বিশেষ কোনও অস্থিরতা আছে।

ভদ্রলোক আবার বললেন, এদিকে দেশটা দিনদিন গোল্লায় যাচ্ছে…এখানে যখন বেটাচ্ছেলে সাহেবরা জিগ্যেস করে, তোমাদের ইন্ডিয়া এত বড় দেশ। সেখানে ওয়ার্ক-ফিলসফি নেই কেন? কাজ করাটা যে একটা পবিত্র ব্যাপার, সেটা এখনও কেউ বোঝাল না..কী উত্তর দোব। বলি, তোমরা, ক্যাপিস্টলিস্টরাই তো আমাদের দেশটাকে চুষে-চুষে ছিবড়ে করে দিয়েছ…। কী, ঠিক কি না? হাঁ করে বসে আছেন কেন, আমি যা বলছি, তা মাথায় ঢুকছে?

–আপনি তো ঠিকই বলছেন?

–আলবাত ঠিক বলব। বিকজ আই নো-ও-ও-ও। আমি নিজে এক সময় মাঠে ঘাটে ঘুরেছি, ভূমিহীন চাষিদের মধ্যে কাজ করেছি…কিন্তু কী লাভ! সবাই বড় বড় বাকতাল্লা দেয়! শ্রেণি সংগ্রাম! হুঁ! মুখের কথা! আজ অবধি কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটাও কথা বলেছে? এমনি-এমনি শ্রেণি-সংগ্রাম হয়? যত সব বামুন কায়েতের লিডারশিপ…

আমি দুবার উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাশলুম। কারণ, ভদ্রলোক খুব জোরে জোরে বাংলায় কথা বলছেন বলে কাছাকাছি অনেকে অবাক হয়ে ফিরে তাকাচ্ছেন।

এবারও ওঁর স্ত্রী ছুটে এলেন। ভদ্রলোকের জামার হাত ধরে বললেন, এই, তোমার খাবার প্লেট ফেলে এসেছ…আমাদের বাড়ি যেতে হবে না? চলো, চলো। আজ কিন্তু আমি গাড়ি চালাব।

হুংকার দিয়ে তিনি বললেন, হোয়াই। আমি চালাতে পারব না? আমি ঠিক আছি, আমার কিচ্ছু হয়নি।

যেতে-যেতে আমার দিকে একটা বিষাক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি বললেন, ভ্যাড়া! আপনারা সব ভ্যাড়ার পাল! সেই জন্যই তো আমাদের নেতাগুলো সব রাখাল টাইপের, তাই একবার বাঁশি বাজাচ্ছে আর একবার ফাঁকা মাঠে লাঠি ঘোরাচ্ছে।

ওঁর স্ত্রী লজ্জিত মুখ করে তাকালেন আমার দিকে।

জয়তীদি এসে জিগ্যেস করলেন, অমুক কী বলছিল তোমাকে?খুব রেগে গেছেন মনে হল।

আমি বললুম, রেগে গেছেন কিনা জানি না, তবে আমায় কিছু বলছিলেন না, স্বগতোক্তি করছিলেন মনে হল।

জয়তীদি বললেন, ও খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে জানো তো…এখানে এসে এত কম বয়েসে যা উন্নতি করেছে…বড়-বড় কম্পানি থেকে ওকে ডাকাডাকি করে…তবে ওই একটা দোষ, একটু হুইস্কি পেটে পড়লেই চ্যাঁচামেচি শুরু করে দেয়।

–বেশি খাটতে হয় বোধহয়, তাই রিলাক্সেশানের জন্য।

–তোমার দীপকদার সঙ্গে তো কতবার ওর তর্ক হয়েছে। তবে ওর মনটা খুব ভালো… জয়তীদি আমার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। অন্য একজন তাঁকে ডেকে নিয়ে চলে গেল।

আমি যুবকটির কথা ভাবতে লাগলুম। বয়েস তিরিশের কাছাকাছি। দশ বছর কলকাতাতেই যায়নি। তাহলে বিয়ে হল কোথায়? কুড়ি বছর বয়েসেই কি বিয়ে করে এসেছিল? অথবা মেয়েটি এসেছিল এদেশে, তারপর দুজনের মন-বিনিময়।

আবার যুবকটি চলে এল আমার দিকে। এবার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই। ওঁর স্ত্রী ওঁকে অনবরত কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু নাটকীয় কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কায় বেশি জোর করতে পারছেন না।

যুবকটির হাতে আর একটা ভরতি গেলাস। এবার অবস্থা বেশ টলটলায়মান।

এবারও বেশ জোর গলায় সে বলল, শুনুন মশাই, আমার বউ প্রায়ই দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য ন্যাগ করে, কিন্তু আমি কেন ফিরে যাব বলতে পারেন? গিভ মি ওয়ান সিংগল সলিড রিজন।

এর কোনও উত্তর হয় না। তাই আমি মুখ নীচু করে সিগারেট ধরাবার জন্য অনেক সময় নিলুম।

উনি আবার বললেন, কেন ফিরে যাব। এখানে আই হ্যাভ মাই ওউন হাউজ..সুইমিং পুল আছে, তিনটে গাড়ি…পৃথিবীর যেকোনও জায়গায় আমি যখন তখন বেড়াতে যেতে পারি…। দেশে গেলে শালা কেউ আমার কাজের দাম দেবে? নিজেরাই কেউ কাজ করতে জানে…গভর্নমেন্টের একটা অর্ডার বেরুতে আঠারো মাস…রেড টেপ আর বিউরোক্রেসি…একটা ফালতু চাকরি দেবে, তারপর ফ্ল্যাট খুঁজে পেতে হয়রান…কেন যাব?

হঠাৎ আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি অসহিষ্ণুভাবে বললুম, কে আপনাকে ফিরে যাওয়ার জন্য মাথার দিব্যি দিয়েছে? আপনাদের মতন লোকেরা দেশে ফিরে গিয়ে এটা নেই, সেটা নেই, উঃ কী গরম, উঃ কী নোংরা, এইসব নিয়ে অনবরত ঘ্যানঘ্যান করেন, তা আমাদের মোটেই শুনতে ভালো লাগে না। আপনারা যেন সবাই এক একটি বাইবেলের প্রডিগ্যাল সন, দেশে ফিরলেই রাজার মতন আদর করতে হবে। আপনাদের বাদ দিয়েও তো দেশটা কোনওক্রমে চলে যাচ্ছে, ডুবে তো যায়নি।

এক তোড়ে বলে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ ভদ্রমহিলার দিকে চোখ পড়ল। তাঁর মুখ থেকে সনির্বন্ধ মিনতি ঝরে পড়ছে। যেন তিনি বলতে চাইছেন, দয়া করে, এই সময় আমার স্বামীর কথায় কিছু মনে করবেন না, ওঁর সঙ্গে তর্ক করবেন না।

তৎক্ষণাৎ আমি লজ্জিত ও অনুতপ্ত বোধ করলুম।

ভদ্রলোক একটু দুলতে-দুলতে বললেন, হুঁ, রাগ আছে তাহলে? বিষ নেই তার কুলোপানা চক্র। দেশে বসে এই রাগ দেখাতে পারেন না? সব ব্যবস্থা চুরমার করে দিতে পারেন না। আমেরিকাতে এসেছেন মজা মারতে?…আমার কথা আলাদা, আই অ্যাম আ প্রিজনার অব ইনডিসিশান…ওয়াক।

ভদ্রলোক ছুটে চলে গেলেন বাথরুমের দিকে। বুঝলাম, এখন বমি করবেন।

অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন তাঁর স্ত্রী।

পার্টি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এরপর খাবারটাবার নেওয়ার জন্য আমায় উঠে যেতে হল টেবিলের দিকে।

একটু পরে দেখলুম সেই ভদ্রলোক বাথরুম থেকে বেরিয়ে একটা চেয়ারে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছেন, চোখ দুটি ওপরের দিকে।

সেরকম দুঃখী, অসহায়, বিভ্রান্ত, করুণ মুখ আমি আর কখনও দেখিনি।