১৯৬তম অধ্যায়
পাত্রভেদে প্রণব জপের ফলপার্থক্য
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি যে চারি আশ্রমের ধর্ম্ম, রাজধৰ্ম্ম, নানাপ্রকার ইতিহাস ও ধর্ম্মার্থযুক্ত হিতকথাসকল কীৰ্ত্তন করিলেন, আমি তৎসমুদয় শ্রবণ করিলাম; কিন্তু এক্ষণে আমার এক মহা সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে, আপনি উহা ভঞ্জন করুন। অধুনা আমি জাপকদিগের [মন্ত্রজপকারিগণের] ফলপ্রাপ্তির বিষয় শ্রবণ করিতে বাসনা করিতেছি। জাপকেরা কি ফল প্রাপ্ত হয়েন এবং পরিণামে কোন্ লোকেই বা অবস্থান করেন? জপানুষ্ঠানের বিধিই বা কিরূপ? জাপক ব্যক্তিকে কি সাংখামতাবলম্বী বা যোগকারী [যোগানুষ্ঠায়ী] অথবা যজ্ঞানুষ্ঠাননিরত বলিয়া নির্দেশ করা যায়? আপনি বিশেষরূপে এই সমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি এই বিষয় উপলক্ষে এক ব্রাহ্মণ, যম, কাল ও মৃত্যুর যে ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে, তাহা কীৰ্ত্তন করিব। মোক্ষধর্ম্মবেত্তা মুনিগণ যে সাংখ্য ও যোগধর্ম্মের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়াছেন, তন্মধ্যে সাংখ্যমতে জপত্যাগ করাই বিধেয় বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে। ঐ মতে মনে মনে ব্রহ্মের উপাসনা করাই কর্ত্তব্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। যাহা হউক, সাংখ্য ও যোগ এই উভয় মতানুসারেই যে পর্য্যন্ত প্রণব জপ করিলে তদ্বারা উপকার দর্শিতে পারে, কিন্তু আত্মসাক্ষাৎকারলাভের পর আর জপ করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। যিনি স্বর্গাদিলাভের কামনা করিয়া জপানুষ্ঠান করেন, তাঁহার চিত্তসংযম, ইন্দ্রিয় পরাজয়, সত্যব্যবহার, অগ্নি-পরিচৰ্য্যা, বিশুদ্ধ আহার, ধ্যান, তপানুষ্ঠান, পরিমিত ভোজন, কামাদি পরাজয়, পরিমিত বাক্যপ্রয়োগ, অমৎসরতা, ক্ষমা ও শান্তিগুণ অবলম্বন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। আর যাঁহারা নিষ্কাম হইয়া জপানুষ্ঠান করেন, তাঁহাদের সমুদয় কৰ্ম্ম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কেবল কুশের উপর উপবেশন, কুশধারণ, কুশদ্বারা শিখাবন্ধন ও গাত্রসমাচ্ছাদন এবং বিষয় পরিত্যাগ ও আত্মাতে মনঃসমাধান করা উচিত; তাঁহারা বীতস্পৃহ হইয়া গায়ত্রাদি জপ করিতে করিতে ব্রহ্মকে ভাবনা করিয়া সমাধি অবলম্বনপূৰ্ব্বক পরিশেষে জপও পরিত্যাগ করিবেন।
“সংহিতাবলে [সংক্ষিপ্তসারসংগ্রহে—বেদসাররূপ প্রণব গায়ত্ৰীজপে] সমাধিজ্ঞান উপস্থিত হয়। বিশুদ্ধচিত্ত, দান্ত, কামদ্বেষহীন এবং রাগ, মোহ ও দ্বন্দ্বপরিশূন্য ব্যক্তিরা কোন দ্রব্যে আসক্ত বা অনুতাপিত হয়েন না। তাঁহাদিগকে কোন কার্য্যের অনুষ্ঠান বা কৰ্জন্য কোন ফল ভোগ করিতে হয় না। উহারা অহঙ্কারবশতঃ অর্থগ্রহণে অভিলাষ, অন্যের অপমান ও অকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন না; নিয়ত ধ্যানে নিযুক্ত থাকিয়া চিত্তের একাগ্রতা সাধনপূৰ্ব্বক ক্রমশঃ তাহাও পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। যাঁহারা সমুদয় বাসনা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ঐ অবস্থায় অবস্থান করিয়া কলেবর পরিত্যাগ করেন, তাঁহারা এককালে ব্রহ্মে লীন হয়েন। যদি তাঁহারা ব্রহ্মে লীন হইতেও ইচ্ছা না করেন, তাহা হইলে তাঁহাদের একেবারে ব্রহ্মলোকে গমন হইয়া থাকে; আর তাঁহাদিগকে জন্মপরিগ্রহ করিতে হয় না। যাঁহারা আত্মার সহিত সাক্ষাৎকারলাভে সমর্থ হয়েন, তাঁহারা রজোগুণবিহীন জরামরণশূন্য, বিশুদ্ধ আত্মাকে লাভ করিয়া থাকেন।”