১৯৬তম অধ্যায়
অশ্বত্থামার সমস্ত পাঞ্চালবধে প্রতিজ্ঞা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ। পুরুষপ্রধান অশ্বত্থামা, দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন ছলপূর্ব্বক পিতাকে নিহত করিয়াছে, শ্রবণ করিয়া বাষ্পকুলনেত্রে ও ক্রোধে নিতান্ত অধীর হইলেন। তাঁহার কলেবর জীবক্ষয়প্রবৃত্ত প্রলয়কালীন অন্তকের ন্যায় ক্রোধে প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। তখন তিনি বারংবার অপূর্ণ নেত্রদ্বয় পরিমার্জিত করিয়া উষ্ণনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, ‘হে রাজন! পিতা অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করিলে নীচাশয় পাণ্ডবগণ যেরূপে তাঁহাকে নিহত করিয়াছে এবং ধর্ম্মধ্বজধারী যুধিষ্ঠিরও যেরূপে অতি অনাৰ্য্য ও নিষ্ঠুর কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করিলাম। যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেই জয় কিংবা পরাজয় হইয়া থাকে। সংগ্রামে বিনাশই প্রশংসনীয়। ব্রাহ্মণেরা কহিয়া থাকেন যে, ন্যায়যুদ্ধে বিনষ্ট হওয়া দুঃখাবহ নহে। আমার পিতা ন্যায়যুদ্ধে কলেবর পরিত্যাগ করিয়া বীরলোকে গমন করিয়াছেন; অতএব তাঁহার নিমিত্ত শোক করা কর্ত্তব্য নহে; কিন্তু তিনি যে ধর্ম্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াও সমস্ত সৈন্যসমক্ষে কেশাকর্ষণদুঃখ অনুভব করিয়াছেন, তাহাতেই আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। আমি জীবিত থাকিতে যখন আমার পিতা এইরূপ দুরবস্থাগ্রস্থ হইলেন, তখন অন্য লোকে কি নিমিত্ত পুত্রকামনা করিবে? লোকে কাম, ক্রোধ, অজ্ঞানতা, দ্বেষ ও বালকত্ব নিবন্ধনই অধর্ম্মাচরণ ও অন্যকে পরাভব করিয়া থাকে। দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন আমাকে বিশেষ না জানিয়াই এই দারুণ অধর্ম্মকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছে। এক্ষণে সেই দুরাত্মা অবশ্যই স্বকার্য্যের ফল অনুভব করিবে। আর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ছলপূর্ব্বক আচাৰ্য্যকে অস্ত্র পরিত্যাগ করাইয়াছেন। আজ বসুন্ধরা অবশ্যই তাহার শোণিত পান করিবেন। হে রাজন! আমি সত্য ও ইটপূৰ্তর্ধারা শপথ করিয়া কহিতেছি যে, সমস্ত পাঞ্চাল বিনষ্ট না করিয়া কখনই জীবন ধারণ করিব না। আজ আমি মৃদু বা দারুণ যে কোনরূপে হউক না কেন, সমরে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সমস্ত পাঞ্চালগণকে বিনাশ করিয়া শান্তিলাভ করিব। মানবগণ পুত্ৰদ্বারা ইহকাল ও পরকালে মহাভয় হইতে পরিত্রাণ পাইবে বলিয়াই পুত্র কামনা করিয়া থাকে; কিন্তু আমি আমার পিতার শৈলপ্রতিম পুত্র, বিশেষতঃ শিষ্য জীবিত থাকিতে তিনি বন্ধুহীনের ন্যায় সেই দুরবস্থা প্রাপ্ত হইলেন। অতএব আমার বাহুবল, পরাক্রম ও দিব্যাস্ত্ৰসকলে ধিক! যাহা হউক, এক্ষণে আমি যাহাতে পরলোকগত পিতার ঋণ হইতে মুক্ত হইতে পারি, অবশ্যই তাহার অনুষ্ঠান করিব।
অশ্বত্থামার নারায়ণস্ত্রমাহাত্ম্য প্রকাশ
‘হে ভরতসত্তম। স্বমুখে স্বীয় গুণকীর্ত্তন করা কদাপি সাধুজনের কৰ্তব্য নহে; কিন্তু আমি পিতৃবিনাশ সহ্য করতে না পারিয়াই আপনার পৌরুষ প্রকাশ করিতেছি। আজ জনার্দ্দনসহায় পাণ্ডবগণ আমার পরাক্রম সন্দর্শন করুক। আমি যুগান্তকালের ন্যায় সমস্ত সৈন্য বিমর্দ্দন করিয়া বিচরণ করিব। কি দেব, কি গন্ধর্ব্ব, কি অসুর, কি উরগ, কি রাক্ষস, কেহই আজ আমাকে সমরে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবেন না। এই ভূমণ্ডলে আমার ও অর্জ্জনের সমান অবিশারদ আর কেহই নাই। আজ আমি প্রজ্বলিত ময়ূখমালা মধ্যবর্তী মার্ত্তণ্ডের ন্যায় তেজঃসম্পন্ন সৈন্যগণের মধ্যগত হইয়া দৈবাস্ত্র প্রয়োগ করিব। আজ আমার শরজাল তূণীরবহির্গত হইয়া পাণ্ডবগণকে বিদলিত করিয়া আমার পরাক্রম প্রকাশ করিবে। আজ কৌরবপক্ষীয়েরা দেখিতে পাইবেন যে, দিকসকল আমার জলধরসদৃশ শরধারায় সমাচ্ছন্ন হইয়াছে। মহাবাহু যেমন বৃক্ষসমুদয় পাতিত করে, তদ্রূপ আমি শরজালপ্রভাবে শত্রুগণকে নিপাতিত করিব।
‘হে মহারাজ! আমার নিকট নিক্ষেপ ও উপসংহার [নিবৃত্তিকারক—ফিরাইয়া আনা] মন্ত্রসমবেত যে অস্ত্র আছে, কি অর্জ্জুন, কি কৃষ্ণ, কি ভীমসেন, কি নকুল, কি সহদেব, কি রাজা যুধিষ্ঠির, কি দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন, কি শিখণ্ডী, কি সাত্যকি কেহই সেই অস্ত্র অবগত নহে। হে মহারাজ! পূর্ব্বে একদা নারায়ণ ব্রাহ্মণবেশ ধারণপূর্ব্বক পিতার নিকট উপস্থিত হইলে তিনি তাঁহাকে যথাবিধি প্রণামপূর্ব্বক উপহার প্রদান করিয়াছিলেন। ভগবান্ নারায়ণ সেই উপহার স্বীকার করিয়া তাঁহাকে বর প্রদান করিতে উৎসুক হইলেন। তখন আমার পিতা তাঁহার নিকট হইতে নারায়ণাস্ত্র প্রার্থনা করিলে তিনি তাহা প্রদান করিয়া কহিলেন, ‘হে ব্ৰহ্মন্। রণস্থলে তোমার তুল্য যোদ্ধা আর কেহই হইবে না; কিন্তু তুমি সহসা এ অস্ত্র প্রয়োগ করিও না। ইহা শত্রুর বিনাশসাধন না করিয়া কখনই নিবৃত্ত হয় না। এই অস্ত্র সকলকেই বিনাশ করিতে পারে, ইহা অবধ্যের বধসাধনেও পরাঙ্মুখ হয় না; অতএব ইহা সহসা প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য নহে। সমরাঙ্গনে রথ ও অস্ত্রপরিত্যাগে অভিলাষী ও শরণাগত শত্রুগণের প্রতি এই অস্ত্র নিক্ষেপ করা উচিত নহে। যে ব্যক্তি অদ্বারা অবধ্যকে পীড়িত করে সে স্বয়ং ইহাদ্বারা নিপীড়িত হয়। হে মহারাজ! ভগবান নারায়ণ এই বলিয়া সেই মহাস্ত্র প্রদান করিলে পিতা উহা গ্রহণ করিলেন। তখন সেই মহাত্মা আমাকে কহিলেন, ‘হে অশ্বত্থামা! তুমি এই অস্ত্রপ্রভাবে তেজঃপুঞ্জকলেবর হইয়া নানাবিধ দিব্য অস্ত্র বর্ষণ করিতে সমর্থ হইবে।’ এই বলিয়া ভগবান্ নারায়ণ স্বর্গলোকে গমন করিলেন।
‘হে রাজন! আমি এইরূপে পিতার নিকট সেই নারায়ণাস্ত্র লাভ করিয়াছি; এক্ষণে তদ্দারা দানববিদ্রাবী শচীপতির ন্যায় আমি পাণ্ডব, পাঞ্চাল, মৎস্য ও কেকয়গণকে বিদ্রাবিত করিব। আমি যখন যেরূপ বাসনা করিব, আমার শরনিকর তৎক্ষণাৎ সেইরূপ হইয়া শত্রুমণ্ডলে নিপতিত হইবে। আমি রণস্থলে অবস্থানপূর্ব্বক অনাকুলিতচিত্তে অয়োমুখ শরনিকর ও বিবিধ পরশু নিক্ষেপ করিয়া মহারথগণকে বিভ্রাবিত ও অতি ভীষণ নারায়ণাস্ত্রদ্বারা পাণ্ডবগণকে পীড়িত করিয়া অরাতিগণকে বিনষ্ট করিব। আজ মিত্র, ব্রাহ্মণ ও গুরুদ্ৰোহকারী পাষণ্ড পাঞ্চালাপসদ ধৃষ্টদ্যুম্ন কখনই আমার হস্তে পরিত্রাণ পাইবে না।’
“হে কুরুরাজ! মহাবীর দ্রোণতনয় এই কথা কহিলে কৌরব সৈন্যগণ প্রতিনিবৃত্ত হইয়া হৃষ্টচিত্তে শঙ্খ, ভেরী ও ডিণ্ডিম প্রভৃতি বাদিত্র বাদন করিতে লাগিল। ভূতল অশ্বখুর ও রথচক্রে পরিপীড়িত হইয়া শব্দায়মান হইল। সেই তুমুল শব্দে ভূমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও আকাশমণ্ডল প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। তখন মহারথ পাণ্ডবগণ সেই মেঘগভীর তুমুল শব্দ শ্রবণে সকলে সম্মিলিত হইয়া মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। এদিকে আচাৰ্য্যপুত্র অশ্বত্থামাও ঐ সময়ে সলিলস্পর্শপূর্ব্বক নারায়ণাস্ত্র প্রাদুর্ভুত করিলেন।”