১৯৫তম অধ্যায়
যোগজ সিদ্ধিলাভের পথ
ভীষ্ম কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! এক্ষণে মহর্ষিগণ যাহা সবিশেষ অবগত হইয়া শাশ্বত সিদ্ধি লাভ করিয়া থাকেন, আমি সেই চতুর্ব্বিধ ধ্যানের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। জ্ঞানতৃপ্ত মোক্ষার্থী মহর্ষিগণ যাহাতে নিৰ্বিঘ্নে ধ্যানসমাহিত হয়, তাহারই অনুষ্ঠান এবং সংসারদোষ হইতে মুক্তিলাভপূৰ্ব্বক পরমাত্মাতে মনঃসংযোগ করিয়া থাকেন। তাঁহাদিগকে পুনরায় আর জন্মপরিগ্রহ করিতে হয় না। তাঁহারা ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি দোষশূন্য, প্রকৃতিস্থ, শীতোত্তাপাদিসহিষ্ণু [শীত-তাপসহনক্ষম], সত্ত্বগুণাবলম্বী ও প্রতিগ্রহশূন্য হইয়া কলত্ৰাদিসংসর্গবিরহিত প্রতিপক্ষশূন্য মনঃপ্রসাদকর স্থানে কাষ্ঠের ন্যায় স্থিরভাবে উপবেশনপূর্ব্বক ধ্যেয় বস্তুর সহিত মনের ঐক্য করিয়া থাকেন। তৎকালে শ্ৰোত্ৰদ্বারা শব্দ, ত্বত্দ্বারা স্পর্শ, চক্ষুদ্বারা রূপ, জিহ্বদ্বারা রস এবং নাসিকাদ্বারা গন্ধ অনুভব করেন না। ফলতঃ তাঁহারা ধ্যানপ্রভাবে সমুদয় ইন্দ্রিয়কার্য্য পরিহার করিয়া থাকেন। যাহারা শ্রোত্র প্রভৃতি পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে ব্যাকুলিত করে, সেই শব্দাদি বিষয়সকল অনুভব করিতে তাহাদিগের আর অভিলাষ হয় না।
“এইরূপে বিচক্ষণ ব্যক্তি শ্ৰোত্রাদি পাঁচ ইন্দ্রিয়কে মনোমধ্যে সন্নিবেশিত করিয়া উহাদের সহিত উদ্ভ্রান্ত চিত্তকে স্থিরীকৃত করিবেন। মনঃ সৰ্ব্বদাই বিষয়সঞ্চারে ব্যাপৃত ও অস্থির বিষয়ে নিত্য নিমগ্ন থাকে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় উহার পঞ্চ দ্বারস্বরূপ; অতএব মনকে সর্ব্বাগ্রে ধ্যানমার্গে অতি প্রযত্নসহকারে সমাহিত করিবে। সেই পঞ্চেন্দ্রিয়সম্পন্ন জীবনের ষষ্ঠ অঙ্গভূত মন এইরূপে নিরুদ্ধ হইলেও মেঘমধ্যে বিদ্যুৎপ্রকাশের ন্যায় বারংবার বিষয় গ্রহণে স্ফুরিত হইয়া থাকে। পদ্মপত্রস্থ সলিলবিন্দু যেমন পত্ৰমধ্যে থাকিয়াও অতিশয় চঞ্চল হয়, তদ্রূপ জীবের মন ধ্যানমার্গে অবস্থান করিয়াও অতিমাত্র চপলভাব ধারণ করে। যদিও মনকে ধ্যানপথে কিছুমাত্র স্থির করা যায়, কিন্তু উহা নাড়ীমার্গে প্রবেশ করিলে পুনরায় উদ্ভ্রান্ত হইয়া উঠে। ঐ সময় ধ্যানযোগবিশারদ মহাত্মা আলস্য ও নিৰ্ব্বেদ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মৎসরাববাজ্জত হইয়া ধ্যানপ্রভাবে পুনরায় মনঃ সমাধান করিবেন। যোগী ব্যক্তি যোগানুষ্ঠান আরম্ভ করিলে প্রথমতঃ তাঁহার বিচার, বিতর্ক ও বিবেকনামে সমাধি উপস্থিত হয়। মন নিতান্ত কাতর হইলেও একাগ্রতা অবলম্বনপূৰ্ব্বক আপনার হিতসাধন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। যোগী ব্যক্তির যোগবিষয়ে নিৰ্ব্বেদযুক্ত হওয়া কোনক্রমেই বিধেয় নহে। পাংশু, ভস্ম ও শুল্ক গোময়ের রাশিতে জল নিক্ষেপ করিবামাত্র উহা কদাপি সম্পূর্ণরূপ আর্দ্র হয় না। উহাতে যেমন অনেকক্ষণ জলসেক করিতে করিতে উহা ক্রমশঃ আর্দ্র হইতে থাকে, তদ্রূপ ইন্দ্রিয়গ্রামকে ক্রমশঃ বশীভূত করা আবশ্যক। এইরূপে মনঃ ও ইন্দ্রিয়সকলকে ধ্যানপথে অবস্থাপনপূৰ্ব্বক ক্রমে ক্রমে প্রসন্ন করিতে পারিলে পরিণামে উহাদের ও আত্মার সম্পূর্ণরূপে শান্তিলাভ হয়। মন ও ইন্দ্রিয়গণের শান্তিলাভ হইলেই যোগী অনায়াসে স্বয়ং শান্তি লাভ করিতে পারেন। যোগিগণ যোগপ্রভাবে যেরূপ সুখলাভ করিয়া থাকেন, অন্যান্য ব্যক্তি দৈব বা পুরুষের দ্বারা কদাচ সেরূপ সুখলাভে সমর্থ হয়েন না। হে ধৰ্ম্মরাজ! মুনিগণ এইরূপে ধ্যানপ্রভাবে সেই অনির্ব্বচনীয় পরমানন্দ সম্ভোগ করিয়া নিরুপদ্রবে মোক্ষপদ লাভ করেন।”