১৯৫. দ্রুপদ কর্তৃক পাণ্ডবগণের পরিচয় জিজ্ঞাসা, দ্রৌপদীর বিবাহ-প্রস্তাব
পঞ্চনবত্যধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে ভরতবংশাবতংস জনমেজয়! তদনন্তর পাঞ্চালরাজ যুধিষ্ঠিরকে আহ্বান করিয়া ব্রাহ্মবিধানানুসারে বিবাহ দিবার অভিপ্রায়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনারা ব্রাহ্মণ, কি ক্ষত্রিয়, কি গুণসম্পন্ন বৈশ্য, কিম্বা শূদ্র, অথবা কোন দেবতা মায়া করিয়া ব্রাহ্মণবেশ ধারণপূর্বক ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতেছেন, ইহা কিরূপে জানিতে পারিব। দ্রৌপদীসন্দর্শনার্থ অনেকানেক দেবগণ আগমন করিয়াছিলেন। অতএব আপনি কে? সত্য করিয়া বলুন, আমার মনে মহা সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে। হে পরন্তপ! আপনি সমুদায় সত্য করিয়া বলুন; সত্যই রাজাদিগের অতীব আদরণীয়; অভীষ্টসিদ্ধির ব্যাঘাত জন্মিলেও তাহাদের মিথ্যা কথা বলা উচিত নহে। হে অরিন্দম! আপনার নিকট যথার্থ তত্ত্ব অবগত হইয়া আমি বিধিপূর্বক বিবাহের উদ্যোগ করিব।
যুধিষ্ঠির কহিলেন, রাজন্! উদ্বিগ্ন হইবেন না, প্রীতি লাভ করুন, আপনার মনোরথ সম্পূর্ণ হইল। আমরা ক্ষত্রিয়, মহাত্মা পাণ্ডুর তনয়, সাধুশীলা কুন্তী আমাদিগের জননী; আমি সর্বজ্যেষ্ঠ, আমার নাম যুধিষ্ঠির; ইহাদিগের একের নাম ভীমসেন, অপরের নাম অর্জুন; ইহারাই রাজসভায় আপনার কন্যাকে জয় করিয়াছেন। আর যে স্থানে দ্রৌপদী রহিয়াছেন, তথায় নকুল, সহদেব ও জননী অবস্থিতি করিতেছেন। হে নরর্ষভ! আমরা ক্ষত্রিয়, আপনি মনোদুঃখ দূর করুন। আপনার কন্যা পদ্মিনীর ন্যায় হ্রদ হইতে হ্ৰদান্তর প্রাপ্ত হইলেন। মহারাজ! আপনাকে এই সমুদায় যথার্থ তত্ত্ব নিবেদন করিলাম, আপনি আমাদিগের পরম পূজনীয় ও আশ্রয়স্থান।
দ্রুপদরাজ যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণ করিয়া আহলাদে ক্ষণকাল বা নিষ্পত্তি করিতে সমর্থ হইলেন। পরে, যত্নপূর্বক হর্ষোৎফুল্ললোচনে হর্ষোদ্রেক কিঞ্চিৎ সম্বরণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমরা কিরূপে রাজ্যচ্যুত ও নগর হইতে বহিষ্কৃত হইলে? যুধিষ্ঠির অনুপূর্বিক সমস্ত বৃত্তান্ত রাজাকে নিকে দন করিলেন। রাজা শ্রবণ করিয়া বারম্বার ধৃতরাষ্ট্রের নিন্দা করিতে লাগিলেন এবং তাহাদিগকে রাজ্য প্রদান করিবেন, এইরূপ প্রতিশ্রুত হইয়া যুধিষ্ঠিরকে আশ্বাসিত করিলেন।
অনন্তর কুন্তী, কৃষ্ণ, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব নৃপাদিষ্ট হইয়া ভবনে প্রবেশ করিলেন। তথায় যজ্ঞসেন কর্তৃক পুজিত হইয়া উপবেশন করিলেন। পরে প্রত্যাশ্বস্ত রাজা পুত্রের সহিত মিলিত হইয়া যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, অদ্য শুভ দিবস, অতএব অর্জুন অভদয়িক ক্রিয়ান্তে দ্রৌপদীর পাণিগ্রণ করুন। যুধিষ্ঠির কহিলেন,রাজন্! আমারও দারসম্বন্ধ কর্তব্য হইয়াছে। দ্রুপদ প্রত্যুত্তর করিলেন, আপনি আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করুন, অথবা আপনার মনোনীত ব্যক্তিকে বিবাহ করিতে অনুমতি করুন। যুধিষ্ঠির কহিলেন, মহাশয়! পূৰ্বে জননী অনুমতি করিয়াছেন যে,দ্রৌপদী আমাদিগের সকলেরই মহিষী হইবেন। আমি অদ্যাপি দার পরিগ্রহ করি নাই এবং ভীমও অকৃতবিবাহ। অর্জুন আপনার কন্যারত্ন জয় করিয়াছেন বটে, কিন্তু আমাদিগের ভ্রাতৃবর্গের মধ্যে নিয়ম আছে যে, যে কোন উৎকৃষ্ট বস্তু প্রাপ্ত হইলে আমরা তাহা সকলে একত্র ভোগ করিয়া থাকি; অতএব আমরা কোনক্রমেই চির অচরিত নিয়ম লঙ্ঘন করিতে পারিব না; কৃষ্ণা ধর্মতঃ আমাদিগের সকলেরই মহিষী হইবেন। অগ্নি সাক্ষী করিয়া আমাদিগের জ্যেষ্ঠাদিক্রমে তনয়ার পরিণয় ক্রিয়া সম্পাদিত করুন। দ্রুপদ কহিলেন, হে কুরুনন্দন! এক পুরুষের বহু পত্নী বিহিত আছে বটে, কিন্তু এক স্ত্রীর অনেক পতি কুত্রাপি শ্রবণগোচর করি নাই। তুমি অতি পবিত্রস্বভাব ও পরম ধাৰ্ম্মিক, তোমার এরূপ কথা উত্থাপন করা অনুচিত। লোকাচার ও কেবিরুদ্ধ অধর্ম কর্মের অনুষ্ঠান করা কদাচ তোমার উচিত হয় না। যুধিষ্ঠির কহিলেন, মহারাজ! ধর্ম অতি সূক্ষ পদার্থ, ধর্মের প্রতি আমরা কিছুই জানি না, পূর্বপুরুষদিগের আচরিত পদ্ধতিক্রমেই চলিয়া থাকি। আমার মুখে অমৃত বাক্য কদাচিত উচ্চারিত হয় না এবং আমার হৃদয়েও অধর্ম কদাচ স্থান লাভ করিতে পারে না। বিশেষতঃ আমাদিগের জননী এ বিষয়ে আদেশ প্রদান করিয়াছেন, আমারও ইহা মনোগত বটে। রাজন! ইহা সনাতন ধর্ম, আপনি ইহার অনুষ্ঠান করুন, কিঞ্চিত্র শঙ্কিত হইবেন না। দ্রুপদ কহিলেন, হে কৌন্তেয়! কল্য তুমি ও তোমার জননী এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন, তোমরা সকলে ইতিকৰ্তব্যতা স্থির করিয়া যাহা বলিবে, তাহাই করিব। বৈশম্পায়ন কহিলেন, রাজন! তাঁহারা সকলে মিলিত হইয়া বিবাহবিষয়ক এইরূপ কথোপকথন করিতেছেন, ইত্যবসরে যদৃচ্ছাক্রমে মহর্ষি দ্বৈপায়ন তথায় সমুপস্থিত হইলেন।