১৯১তম অধ্যায়
বর্ণাশ্রমধর্ম্ম—ব্ৰহ্মচৰ্য্য আশ্রম
“ভরদ্বাজ কহিলেন, ‘মহাত্মন্! দান, ধৰ্ম্ম, আচার, তপস্যা, বেদাধ্যয়ন ও হোমকার্য্যে কি ফলোদয় হয় তাহা কীৰ্ত্তন করুন।’
“ভৃগু কহিলেন, ‘ব্রহ্মন্! হোমদ্বারা ভোগ ও তপস্যা দ্বারা স্বর্গলাভ হইয়া থাকে। দান দুই প্রকার—ঐহিক ও পারলৌকিক। অসৎপাত্রে দান করিলে ঐহিক এবং সৎপাত্রে দান করিলে পারলৌকিক সুখলাভ হয়। যিনি যেরূপ দান করেন, তাহার তদনুরূপ ফললাভ হইয়া থাকে।
“ভরদ্বাজ কহিলেন, ‘মহর্ষে! কে কিরূপ ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিবে, ধৰ্ম্মের লক্ষণ কি এবং ধৰ্ম্ম কয় প্রকার তাহা কীৰ্ত্তন করুন।
“ভৃগু কহিলেন, ‘ব্ৰহ্মন! যে মহাত্মারা স্ব স্ব ধর্ম্ম প্রতিপালনে। অনুরক্ত থাকেন, তাঁহারাই স্বৰ্গফলভোগে সমর্থ হয়েন, আর যাহারা তাহার অন্যথাচরণে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা অত্যন্ত মূঢ়।’
“ভরদ্বাজ কহিলেন, ‘মহাত্মন্! পূৰ্ব্বে মহর্ষিরা চারি আশ্রমের যেরূপ ধৰ্ম্মনির্ণয় এবং তাঁহারা স্বয়ং যেরূপ আচার ব্যবহার করিয়া গিয়াছেন, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।’
“ভৃগু কহিলেন, ‘ব্রহ্মন্! প্রথমতঃ ভগবান্ ব্রহ্মা প্রজাগণের হিতসাধন ও ধৰ্ম্মরক্ষণার্থ চারি আশ্রম নিরূপিত করিয়া দিয়াছেন। ঐ চারি আশ্রমের মধ্যে ব্রহ্মচর্য্যকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। আশ্রমবাসীরা পবিত্রতা, সংস্কার, বিনয়, নিয়ম ও ব্রতপ্রভাবে সংযত হইয়া প্রাতঃকালে সূৰ্য্য ও সায়ংকালে অগ্নির উপাসনা এবং নিন্দা ও আলস্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক গুরুর আজ্ঞানুবর্তী হইয়া তাঁহার শুশ্রূষা, অভ্যর্থনা, বেদাভ্যাস, বেদার্থগ্রহণ, তিনবার স্নান, অগ্নিরক্ষা ও নিত্য ভিক্ষাবৃত্তি প্রভৃতি কাৰ্য্যদ্বারা আত্মার পবিত্রতা সম্পাদন করিয়া থাকেন। শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট আছে যে, যাঁহারা গুরুর আরাধনা করিয়া বেদজ্ঞান লাভ করিতে পারেন, তাঁহাদিগের নিশ্চয়ই স্বৰ্গফলপ্রাপ্তি ও অভীষ্টসিদ্ধি হয়।
গার্হস্থ্য আশ্রম—সংসার
‘গার্হস্থ্য দ্বিতীয় আশ্রম; এই আশ্রমের আচার ও লক্ষণসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যাঁহারা ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম হইতে নির্গত ও সদাচারে নিরত হইয়া ধৰ্ম্মানুষ্ঠান জন্য ফললাভে অভিলাষী হয়েন, গৃহস্থাশ্রম তাঁহাদিগের নিমিত্তই বিহিত হইয়াছে। এই আশ্রমে ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গ লাভ হইয়া থাকে। গৃহস্থ ব্যক্তি আকর [পৈতৃক সম্পত্তি ক্ষেত্র, খনি প্রভৃতি] হইতে প্রাপ্ত অথবা স্বীয় বেদাধ্যয়নপ্রভাব, যাজনাদিক্রিয়া ও হোমাদি নিয়মজনিত দেবতার প্রসাদলব্ধ ধনদ্বারা সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিবেন। এই আশ্রম সমুদয় আশ্রমের মূল। কি গুরুকুলনিবাসী কি পরিব্রাজক, কি অন্যান্য ব্রতনিয়মধৰ্ম্মানুষ্ঠায়ী, সকলেরই এই আশ্রম হইতে ভিক্ষাদান ও হোমানুষ্ঠান প্রভৃতি কার্য্য সম্পন্ন হইয়া থাকে। বানপ্রস্থাশ্রমীদিগের ধনসঞ্চয় নিষিদ্ধ। উঁহারা প্রায়ই বেদাধ্যয়ন ও তীর্থদর্শন-প্রসঙ্গে পৃথিবী পর্য্যটন করিয়া থাকেন। উঁহাদিগকে, দর্শনমাত্র অসূয়াশূন্যচিত্তে গাত্রোত্থান, অভিগমন, অভিবাদন ও মিষ্টসম্ভাষণপূৰ্ব্বক সাধ্যানুসারে আসন, শয়ন ও আহারপ্রদান এবং পূজা করা গৃহস্থের অবশ্য কর্ত্তব্য। শাস্ত্রে কথিত আছে যে, যে গৃহস্থ সাধ্যানুসারে অতিথিসৎকার না করে, অতিথি তাহার গৃহ হইতে হতাশ হইয়া প্রতিনিবৃত্ত হইবার সময় তাহাকে স্বীয় সঞ্চিত পাপ প্রদানপূৰ্ব্বক তাহার পুণ্যরাশি গ্রহণ করিয়া থাকে। গৃহস্থাশ্রমে যজ্ঞানুষ্ঠানদ্বারা দেবলোক, শ্রাদ্ধতর্পণদ্বারা পিতৃলোক, বেদাধ্যয়নাদিদ্বারা ঋষিলোক এবং পুত্রোৎপাদনদ্বারা প্রজাপতির প্রীতিসম্পাদন করা যাইতে পারে। শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট আছে যে, সকলের সহিত সুমধুর প্রিয়সম্ভাষণ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। নিন্দা, পরুষবাক্য প্রয়োগ, অবজ্ঞা, অহঙ্কার বা দাম্ভিকতা প্রকাশ করা কদাপি বিধেয় নহে। অহিংসা, সত্য ও অক্রোধ সমুদয় আশ্রমেরই উৎকৃষ্ট তপস্যাস্বরূপ। গৃহস্থাশ্রমে মাল্যাভরণধারণ, বস্ত্রপরিধান, তৈলমর্দ্দন, গন্ধদ্রব্যসেবন, নৃত্যদর্শন, গীতবাদ্যশ্রবণ, বিহার এবং চৰ্ব্ব-চুষ্য-লেহ্য-পেয়াদি বিবিধ দ্রব্যের উপভোগে অসীম সুখলাভ হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি গৃহাশ্রমে থাকিয়া ত্রিবর্গসাধন এবং সত্ত্ব ও তমোগুণের চরিতার্থতা সম্পাদন করিতে সমর্থ হয়েন, তিনি সাধুজনোচিত গতি লাভ করিয়া থাকেন। এই আশ্রমে থাকিয়া সতত কাম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক উঞ্ছবৃত্তির অনুষ্ঠান করিয়াও স্বধর্ম্ম প্রতিপালন করিলে স্বর্গলাভ দুর্ল্লভ হয় না।’ ”